
ছবি: সংগৃহীত
দুর্নীতির অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতে দেওয়া রায় নিয়ে এবার বড় প্রশ্ন তুলেছে দেশের উচ্চ আদালত। বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো, সাক্ষ্য গ্রহণের অস্বাভাবিক গতি, ন্যূনতম আইনি শর্ত পূরণ না হওয়া এবং একপাক্ষিক রায় ঘোষণার মতো একাধিক গুরুতর অসঙ্গতি তুলে ধরে হাইকোর্ট বলেছে—এই মামলার বিচার নিরপেক্ষ হয়নি বলে বিশ্বাস জন্ম নেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
সোমবার (১৪ জুলাই) সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে মামলার ৫২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। তাতে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে বিচারিক আদালতের কার্যক্রমে যুক্তিসঙ্গত সময় ও ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়ার ব্যত্যয় ঘটেছে।
এর আগে গত ২৮ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. খসরুজ্জামানের একক বেঞ্চ তারেক রহমান ও জুবাইদা রহমানের আপিল শুনানি শেষে পূর্বঘোষিত রায়ে তাদের সাজা বাতিল করে খালাস দেন। ১৪ মে তাদের জামিন দেওয়া হয় এবং আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়।
হাইকোর্ট তার পূর্ণাঙ্গ রায়ে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে, বিচারিক আদালতে এ মামলার বিচার স্বাভাবিক গতিতে হয়নি। বরং সেখানে এমন দ্রুততার সঙ্গে সাক্ষ্য গ্রহণ এবং রায় ঘোষণা করা হয়েছে, যা ন্যায়বিচারের মৌলিক চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রায়ে বলা হয়— "মাত্র দুই মাস চার দিনে ৪২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ এবং আট দিনের মধ্যে রায় ঘোষণা—এই ঘটনাক্রম বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে জনগণের মনে যথার্থই সন্দেহ তৈরি করে।"
এ ছাড়া, জুবাইদা রহমানকে মামলা সংক্রান্ত কোনো নোটিশ না পাঠিয়েই অভিযোগ গঠন এবং বিচার সম্পন্ন করার বিষয়টিকে হাইকোর্ট আইনানুগ প্রক্রিয়ার পরিপন্থী বলেও অভিহিত করেছে।
২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কাফরুল থানায় তারেক রহমান, জুবাইদা রহমান এবং তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।
এই মামলায় দীর্ঘ তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়া শেষে ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তারেক রহমানকে দুদক আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ধারায় তিন বছর ও ২৭(১) ধারায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়ে মোট ৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং তিন কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে, জুবাইদা রহমানকে ২৭(১) ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন জুবাইদা রহমান। হাইকোর্ট শুনানি শেষে ২৬ মে আপিলের শুনানি সম্পন্ন করে এবং ২৮ মে রায় ঘোষণা করে তাদের সাজা বাতিল করে খালাস দেন। ১৪ মে জামিন পাওয়ার পর থেকে তারা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, "এই মামলায় অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ ও রায় ঘোষণার পদ্ধতিতে এমন একতরফা আচরণ পরিলক্ষিত হয়েছে যা স্বাভাবিক আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।"
২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করা হয়। তখনই তারেক রহমান, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, সাইফুর রহমানসহ বহু রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়। জুবাইদা রহমান, যিনি চিকিৎসক হিসেবে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছিলেন, তাকেও এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এই মামলাগুলোর অনেকগুলোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পক্ষপাতমূলকভাবে পরিচালিত হয়েছে বলে দাবি করে আসছে বিএনপি। হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায় সেই অভিযোগের পক্ষে কার্যত একটি আইনি স্বীকৃতি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায় শুধু তারেক-জুবাইদার খালাস নয়, বরং এটি বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা সম্পর্কেও বড় বার্তা বহন করে। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে এ ধরনের মামলায় উচ্চ আদালতের নজরদারির প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো করেছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, "এই রায় প্রমাণ করেছে, তারেক রহমান ও ডা. জুবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে মামলা পরিচালনা করা হয়েছিল। বিচারিক আদালত সরকারের চাপ ও নির্দেশে কাজ করেছে।"
অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে দুদক সূত্র বলছে, তারা পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যালোচনা করে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
হাইকোর্টের এই রায় শুধুমাত্র একটি মামলার রায় নয়—এটি দেশের বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃনির্মাণে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারেক রহমান ও জুবাইদা রহমানের সাজা বাতিলের পাশাপাশি বিচারিক আদালতের ভূমিকা নিয়ে হাইকোর্ট যে কঠোর মন্তব্য করেছে, তা বিচারক, প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থাসমূহের জন্যও একটি বার্তা—ন্যায়বিচার শুধু প্রদর্শন করলেই হয় না, বাস্তবেও তা নিশ্চিত করতে হয়।
বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে এই রায়। অনেকের মতে, এই রায়ের প্রেক্ষিতে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—এই রায় শুধু আইনি লড়াইয়ের পরিণতি, নাকি আগামীদিনের রাজনৈতিক সমঝোতারও পূর্বাভাস?
বাংলাবার্তা/এমএইচ