
ছবি: সংগৃহীত
চীন-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দীর্ঘদিনের একটি স্পর্শকাতর ও উত্তেজনাপূর্ণ ইস্যু আবারও সামনে চলে এসেছে। এবার সেই ইস্যুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দলাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন। সম্প্রতি দলাই লামার ৯০তম জন্মদিন উপলক্ষে ভারতের একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর অংশগ্রহণ এবং দলাই লামার মন্তব্যে চীন ফের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারত-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
রোববার (১৪ জুলাই) ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অবস্থিত চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র ইউ জিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট দিয়ে বলেন, “বাস্তবিক অর্থে, শিজাং (চীনা নাম তিব্বত) সম্পর্কিত বিষয় ভারত-চীন সম্পর্কে একটি কাঁটা এবং এটি ভারতের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তার এই বিবৃতিকে আন্তর্জাতিক মহল ভারতের বিরুদ্ধে চীনের কূটনৈতিক চাপ ও হুঁশিয়ারির স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে দেখছে। চীনের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, দলাই লামার পুনর্জন্ম ও উত্তরসূরি নির্বাচন একান্তভাবে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এখানে বাইরের কোনো রাষ্ট্রের মন্তব্য বা অংশগ্রহণ অনুচিত।
বিবৃতির পেছনে প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখা যাচ্ছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরুতে দলাই লামার জন্মদিন উদ্যাপন ঘিরে নানা আয়োজন ও মন্তব্য। সেখানে দলাই লামা স্পষ্টভাবে বলেন, “আমার উত্তরসূরি নির্বাচনে চীনের কোনো ভূমিকা নেই। এটি আমার এবং আমার অফিসের সিদ্ধান্ত।”
এই মন্তব্যের পাশাপাশি ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজুও প্রকাশ্যে বলেন, “একজন বৌদ্ধ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, দলাই লামা এবং তার অফিসই তাঁর পুনর্জন্ম নির্ধারণের একমাত্র কর্তৃপক্ষ।”
এইসব মন্তব্য চীনের কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। বেইজিংয়ের মতে, ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনৈতিক ও একাডেমিক মহল ইচ্ছাকৃতভাবে তিব্বতের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে ‘অনুচিত মন্তব্য’ করছে। ইউ জিং বলেন, “পররাষ্ট্র বিষয়ক পেশাদারদের উচিত এই ইস্যুর সংবেদনশীলতা বুঝে চলা।”
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ভারত-চীন সম্পর্কে উত্তেজনা ফের নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্যেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর যাচ্ছেন চীনে, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নিতে।
এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা, কারণ ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যকার প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এটি প্রথম কোনো উচ্চপর্যায়ের সরকারি সফর।
সেই সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় ও ৪ জন চীনা সেনা নিহত হয়েছিলেন। এরপর দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার সামরিক ও কূটনৈতিক বৈঠক হলেও সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি সীমান্ত উত্তেজনার। এই অবস্থায় জয়শঙ্করের সফরকে নতুন করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হলেও তিব্বত ইস্যু ফের সামনে আসায় সেই প্রচেষ্টা বিপর্যস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা।
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দলাই লামা ১৯৫৯ সালে চীনের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ভারতে পালিয়ে আসেন। তখন থেকেই তিনি ভারতের ধর্মশালায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় তিব্বতি নির্বাসিত সরকার, যার প্রতিনিধিরা এখনো ভারতের মাটিতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
ভারতে বর্তমানে আনুমানিক ৭০ হাজারের মতো তিব্বতি উদ্বাস্তুর বসবাস রয়েছে। এদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের ওপর ভারতের নিয়মিত সহানুভূতি ও সমর্থন আছে, যদিও সরকারিভাবে ভারত বারবার জানিয়েছে, তিব্বত ‘চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়’ এবং ভারত তার বিষয়ে সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করে না।
এবার দলাই লামার বয়স ৯০ বছরে পড়ায় তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও আগ্রহ ও উদ্বেগ বাড়ছে। চীন চায়, আগামী দলাই লামার নির্বাচন হবে বেইজিংয়ের অনুমোদিত প্রক্রিয়ায় এবং তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তিব্বতিরা এবং বিশ্বের বহু বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করে, চীনের হস্তক্ষেপ ধর্মীয় স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪ জুলাই এক বিবৃতিতে স্পষ্ট করে জানিয়েছে, “ধর্ম ও বিশ্বাসভিত্তিক বিষয়গুলোতে ভারত সরকার কোনো মন্তব্য করে না। এগুলো ব্যক্তির স্বাধীন বিশ্বাস ও মতের বিষয়।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভারত একদিকে তিব্বতিদের সহানুভূতি ও রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে থাকলেও অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে যেতে চায় না। কিন্তু তিব্বত ইস্যু মাঝে মধ্যেই ভারতকে চাপে ফেলে। আবার এটিকেই কৌশলগতভাবে চীনের বিরুদ্ধে একটি কার্ড হিসেবেও ব্যবহার করে দিল্লি। বিশেষ করে সীমান্ত ও বাণিজ্যিক বিষয়ে আলোচনায় তিব্বত একটা নীরব চাপ তৈরি করে চীনের ওপর।
দলাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনের মতো এক ধর্মীয় প্রশ্ন আবারও ভারত-চীন ভূরাজনৈতিক সম্পর্কে আলোড়ন তুলেছে। চীনের কূটনৈতিক ভাষ্যে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি রয়েছে—তিব্বতের মতো ইস্যুতে ভারত যেন সাবধানে পা ফেলে। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জনগণের অভ্যন্তরীণ সমর্থন তিব্বতিদের প্রতি যথেষ্ট বলিষ্ঠ।
এই উত্তেজনার মধ্যে জয়শঙ্করের চীন সফর ও সম্ভাব্য দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিব্বত প্রসঙ্গ আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় আসে কি না, সেদিকে এখন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি নিবদ্ধ। তবে এতটুকু নিশ্চিত—তিব্বত এখন আর শুধু একটি ধর্মীয় অঞ্চল নয়, এটি পরিণত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী ‘স্পর্শকাতর এলাকা’তে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ