
ছবি: সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি ক্রিকেটার সনাৎ জয়সুরিয়া মনে করেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন এক কঠিন ‘যুগসন্ধিক্ষণ’ পার করছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে গিয়ে তিনি বলছেন, ক্রিকেটারদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) পরিচালনায় থাকা সাবেক তারকা ক্রিকেটারদেরও এগিয়ে আসতে হবে, নিতে হবে চ্যালেঞ্জ। ক্রিকেটারদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারলেই তারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কঠিন সময় পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার জাতীয় দল যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ দলও পারে—এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
বিশ্ব ক্রিকেটে মারকুটে ব্যাটিংয়ের জন্য পরিচিত সাবেক এই ওপেনার এখন দায়িত্ব পালন করছেন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে। দায়িত্ব নেন এমন এক সময়ে, যখন দেশটির ক্রিকেটে পরিবর্তনের ঝড় বইছিল। অভিজ্ঞদের বিদায়ের পর তরুণদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিল তাদের। ঠিক যেমন এখন পার করছে বাংলাদেশ—যেখানে এক যুগের ‘আইকনিক’ তিন ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের অবসর বা অনিয়মিত উপস্থিতিতে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একান্ত আলাপে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন জয়সুরিয়া। বলেন, "আমরা যখন কোচিং শুরু করি, তখন লঙ্কা ক্রিকেটও খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিল না। কিন্তু আমি ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাস জোগাতে শুরু করি। ওদের বলেছি—তোমরা পারবে। অনুশীলনে কিছু ভিন্নতা এনেছি। তারা আমার পরামর্শ মেনে কঠিন পরিশ্রম করেছে। একসময় আমাদের দলটি দারুণ বোঝাপড়া গড়ে তোলে, খেলায় স্বাভাবিকত্ব ফিরে আসে।"
এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার তুলনা টেনে বলেন, "প্রত্যেক দেশেরই এমন এক সময় আসে, যখন অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা একসঙ্গে সরে যায়। তখন নতুনদের নিয়ে দল সাজানো কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশও এখন সেই সময় পার করছে। তবে নতুন ক্রিকেটারদের সাহস ও সমর্থন দিতে হবে। নির্বাচকরা চেষ্টা করছেন, এখন বোর্ডে যেসব সাবেক ক্রিকেটার দায়িত্বে আছেন, তাদেরও নিজেদের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে। তারা চ্যালেঞ্জটা নিলে খুব দ্রুত টাইগাররা ঘুরে দাঁড়াবে—এটা আমার বিশ্বাস।"
জয়সুরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও বেশ পুরোনো। তিনি বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কয়েক বছর খেলেছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। সেসব স্মৃতি এখনও হৃদয়ে লালন করেন তিনি। বলেন, "বাংলাদেশে আমি যতবার খেলেছি, দারুণ ভালোবাসা পেয়েছি। মোহামেডানের হয়ে খেলতে এসে দেখেছি, এ ক্লাবকে ঘিরে কী আবেগ! ভক্তরা আমার খেলার ধরন পছন্দ করত। আমি সবসময় অ্যাটাকিং ক্রিকেট খেলতাম, বাংলাদেশেও সেটাই করেছি। আমি খেলাটা উপভোগ করতাম।"
এই প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, "দীর্ঘ ক্যারিয়ারের পর যখন কোচিংয়ে আসি, এটা আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ছিল। কখনো ভাবিনি কোচ হবো, কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে এদিকে নিয়ে এসেছে। এখন বুঝি, আগের অভিজ্ঞতা কোচিংয়ে কতটা কাজে লাগে।"
তবে একসময় ক্রিকেটের বাইরের এক সিদ্ধান্ত নিয়ে আজীবনের আক্ষেপ রয়েছে তার। শ্রীলঙ্কায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১০-এর দশকে রাজনীতিতে সক্রিয় হন তিনি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী। কিন্তু রাজনীতির সেই অধ্যায় এখন নিজের জীবনের বড় ভুল বলেই মনে করেন তিনি।
নিজের ভুল স্বীকার করে জয়সুরিয়া বলেন, "আমি মনে করি রাজনীতিতে যাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ক্রিকেটার হিসেবে মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতিতে সেটা কখনোই সম্ভব না। এটা আমার জন্য ভুল সিদ্ধান্ত ছিল এবং এখনো আমি সেই সিদ্ধান্তের জন্য আক্ষেপ করি।"
তিনি এও বলেন, "আমি অন্য ক্রিকেটারদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলছে—ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে যাওয়া উচিত নয়। তাদের উচিত ক্যারিয়ারে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, খেলাটাকে উপভোগ করা। কারণ রাজনীতি খুব ভিন্ন জগৎ।"
বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজাও রাজনীতিতে এসেছেন—এমন প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু না বললেও, তিনি যেন তাদেরকেও এই ভুলের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়ার পরোক্ষ বার্তা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, খেলোয়াড় থাকাকালে রাজনীতিতে জড়ানো মানে নিজেকে দুই জায়গায় ভাগ করে নেয়া—যা ক্যারিয়ার এবং খেলার মানসিক প্রস্তুতির জন্য কখনোই ইতিবাচক নয়।
সনৎ জয়সুরিয়ার এই মন্তব্য ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য হতে পারে একটি মূল্যবান শিক্ষা। একদিকে যেমন নতুন ক্রিকেটারদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান, অন্যদিকে সাবেক ক্রিকেটারদের নেতৃত্বে সঠিক পরিকল্পনা ও ত্যাগ—দুটি বিষয়ই বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেটের পটভূমিতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশ যদি জয়সুরিয়ার পথ ধরে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে হয়তো খুব দ্রুতই এই যুগসন্ধিক্ষণ কাটিয়ে একটি নতুন, লড়াকু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দলের রূপ পাবে টাইগাররা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ