
ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার কিংস্টন টেস্ট চলার কথা ছিল অন্তত পাঁচ দিন। কিন্তু সেই টেস্ট শেষ হলো তিন দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই। টেস্ট ক্রিকেটে এমন শ্বাসরুদ্ধকর, রেকর্ডে ভরা এবং একতরফা ম্যাচ সচরাচর দেখা যায় না। তবে অস্ট্রেলিয়ার বোলিং ঝড় ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং বিপর্যয় এমন দৃশ্যই উপহার দিলো।
ম্যাচের শেষ দিনে শুধু একটি নয়, ঘটেছে একাধিক রেকর্ডের জন্ম। একদিকে মিচেল স্টার্ক তার ১০০তম টেস্ট ম্যাচে গড়েছেন অবিশ্বাস্য এক বিশ্বরেকর্ড, অন্যদিকে হ্যাটট্রিক করেছেন স্কট বোল্যান্ড। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিং লাইনআপ নাম লিখিয়েছে এক লজ্জাজনক তালিকায়—তারা অলআউট হয়েছে মাত্র ২৭ রানে, যা টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ।
তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংস দিয়ে। ৯৯ রানে ৬ উইকেট নিয়ে দিন শুরু করে সফরকারীরা। উইন্ডিজ পেসার শামার জোসেফ ও আলজারি জোসেফের দারুণ বোলিংয়ে অজিদের ইনিংস গুটিয়ে যায় মাত্র ১২১ রানে। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার প্রাপ্ত ৮২ রানের লিড মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২০৪ রানের।
কিন্তু এই ছোট লক্ষ্যই পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় উইন্ডিজের সামনে। কেউ কল্পনাও করেনি যে, এক সময় টেস্ট ক্রিকেট শাসন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমনভাবে ভেঙে পড়বে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংস স্থায়ী হয় মাত্র ১৪.৩ ওভার। পুরো দল গুটিয়ে যায় ২৭ রানে। টেস্ট ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ। এর আগে ১৯৫৫ সালে নিউজিল্যান্ডকে ২৬ রানে অলআউট করেছিল ইংল্যান্ড। সেই রেকর্ড আজও টিকে থাকলেও, ক্যারিবীয়দের এই ধস রেকর্ড বইয়ে স্থান করে নিয়েছে লজ্জাজনক অধ্যায়ে।
এই ইনিংসে ৭ জন ব্যাটার শূন্য রানে আউট হন, যা আধুনিক টেস্ট ক্রিকেটে বিরল। কোনো ব্যাটারই দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি। সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৬ রান, সেটাও অতিরিক্ত থেকে।
ম্যাচের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় নিঃসন্দেহে মিচেল স্টার্কের দুর্দান্ত বোলিং। নিজের ১০০তম টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে তিনি নিলেন ৭.৩ ওভারে মাত্র ৯ রানে ৬ উইকেট। তবে শুধু ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়েই নয়, স্টার্ক গড়েছেন টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুত পাঁচ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড।
মাত্র ১৫ বলে ৫টি উইকেট তুলে নিয়ে তিনি ভেঙে দিয়েছেন পূর্বতন রেকর্ড। একইসঙ্গে তিনি পা রেখেছেন আরেক মর্যাদার সিঁড়িতে—টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেটের ক্লাবে প্রবেশ করেছেন স্টার্ক, যা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে তাকে পঞ্চম স্থানে নিয়ে এসেছে।
স্টার্কের পর স্কট বোল্যান্ডও জানিয়ে দিলেন, কেন তাকে দলে রাখা হয়েছে। প্রথম দুই টেস্টে সুযোগ না পাওয়া বোল্যান্ড তৃতীয় টেস্টে মাঠে নেমেই করলেন হ্যাটট্রিক। এক ওভারের তিন বলে ক্যারিবীয়দের ইনিংস ছিন্নভিন্ন করে দেন তিনি।
জশ হ্যাজেলউডও পিছিয়ে ছিলেন না। অস্ট্রেলিয়ার এই আরেক পেসার দারুণ আগ্রাসী বোলিং করেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটারদের বারবার চাপে ফেলেন।
এই তিন পেসারের ভয়ঙ্কর ত্রয়ী যেন ঝড়ের গতিতে উড়িয়ে দিলো ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং লাইনআপ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বিতীয় ইনিংস: ২৭ রান (১৪.৩ ওভার)
অস্ট্রেলিয়ার জয়: ১৭৬ রানে
স্টার্কের বোলিং: ৬/৯
বোল্যান্ডের হ্যাটট্রিক: ৩ উইকেট এক ওভারে
হ্যাজেলউডের সাপোর্টিং স্পেল: যথারীতি ধারাবাহিক ও নিয়ন্ত্রিত
এই জয়ে সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করল প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া। ক্যারিবীয়দের মাঠে এমন চূড়ান্ত আধিপত্য দেখানো সহজ কথা নয়, কিন্তু স্টার্ক-হ্যাজেলউড-বোল্যান্ডরা সেটাই করে দেখালেন।
সিরিজের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য অপেক্ষা করছে টি-টোয়েন্টি সিরিজ। ২১ জুলাই থেকে শুরু হবে পাঁচ ম্যাচের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের লড়াই। তবে টেস্টে এমন বিধ্বস্ত পারফরম্যান্সের পর ক্যারিবীয়রা কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, তা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ক্রিকেটে দুর্বল পারফর্ম করছে। কিন্তু এই সিরিজে, বিশেষ করে কিংস্টনে যেভাবে তারা ভেঙে পড়েছে, তা দেশটির ক্রিকেট কাঠামোর দুর্বলতা আরও প্রকট করে তুলেছে। ২৭ রানে অলআউট হওয়া, ৭ ব্যাটারের শূন্য রানে ফেরত যাওয়া, ১৪.৩ ওভারে ইনিংসের সমাপ্তি—সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি ম্যাচের হার নয়, বরং পুরো ক্রিকেট কাঠামোরই বিপর্যয়ের প্রতিচ্ছবি।
অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়া আবারও প্রমাণ করল কেন তারা বিশ্বের অন্যতম সেরা টেস্ট দল। পেসারদের ধারাবাহিক সাফল্য, আগ্রাসী মনোভাব ও পরিকল্পিত বোলিং-ব্যাটিং মিলিয়ে তারা টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের আধিপত্য অব্যাহত রাখছে।
এই ম্যাচ হয়তো ব্যাট-বলের একটি গল্প, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ ক্রিকেট ইতিহাসে জায়গা করে নিল কিংস্টনের এই তিনদিনের ‘ধ্বংসযজ্ঞ’।
বাংলাবার্তা/এমএইচ