
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে এক বিস্ময়কর পালাবদল ঘটেছে। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও যেখানে ডলার-সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছিল দেশটি, এখন ঠিক উল্টো চিত্র—বাজারে ডলারের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। ফলে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য ক্রমেই নিচে নামছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হস্তক্ষেপ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তবে এবার বাজারে হস্তক্ষেপ করেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কোনো আপত্তি করছে না। অথচ, গত বছর এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফের কড়া আপত্তির মুখে পড়েছিল সরকার।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোমবার (১৫ জুলাই) ব্যাংকগুলোতে ডলারের গড় মূল্য দাঁড়ায় ১১৯ টাকা ৭২ পয়সা। সর্বনিম্ন ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ১২০ টাকা ১০ পয়সায় লেনদেন হয়। অথচ দুই সপ্তাহ আগে ডলারের সর্বোচ্চ দর ছিল ১২৩ টাকা। অর্থাৎ, এই সময়ের মধ্যে ডলারের দাম কমেছে ৩ টাকা ২৮ পয়সা। খোলা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে—সোমবার খোলা বাজারে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়, যা আগের সর্বোচ্চ ১৩২ টাকার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ সম্প্রতি রেকর্ড মাত্রায় বেড়েছে। রপ্তানি আয় এবং বৈদেশিক ঋণের প্রবাহও ঊর্ধ্বমুখী। পাশাপাশি, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি খাতে চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম থাকায় এই অতিরিক্ত সরবরাহে ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে ডলারের দাম কমতে শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। কারণ তারা আগের চড়া দামে ডলার কিনলেও এখন তুলনামূলকভাবে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
ডলারের অতিরিক্ত সরবরাহ ও দাম পতনের কারণে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি বাজারে হস্তক্ষেপ করছে। তবে এবার তারা ডলার বিক্রি নয়, বরং বাজারমূল্যের চেয়েও বেশি দামে ডলার কিনছে—যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
রোববার (১৪ জুলাই) ডলারের গড় বাজারমূল্য ছিল ১২০ টাকা ৬০ পয়সা, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে প্রতি ডলার ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দামে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনে নেয়। এতে ব্যাংকগুলোর জন্য কিছুটা স্বস্তি আসে, কারণ তারা লোকসান কমিয়ে কিছুটা মুনাফা করতে পারে। পাশাপাশি, বাজার থেকে টাকা সরিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে গেছে।
এই প্রশ্ন এখন অর্থনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে যখন ডলারের দাম হঠাৎ বাড়তে থাকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়, তখন আইএমএফ তা কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। সংস্থাটির মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ বাজারের স্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
২০২৩ সালের মে মাসে আইএমএফের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়। তখন তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে ডলারের দাম ব্যাপকভাবে বাড়বে। বাস্তবে তা হয়নি। বরং দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩ টাকায়, যা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। এরপরই শুরু হয় ডলারের মূল্যপতন।
এখন যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও বাজারে হস্তক্ষেপ করছে, কিন্তু এবার উল্টোভাবে—ডলার কিনে বাজারকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে—তখন আইএমএফ কোনো মন্তব্য করছে না। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে: কেন এই নীরবতা?
এটাই প্রথম নয়। ২০২১ সালেও ডলারের সরবরাহ বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখনো বাজার থেকে ডলার কিনেছিল রিজার্ভ বাড়াতে। তখনো আইএমএফ কোনো আপত্তি করেনি। তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, আইএমএফের আপত্তির ধরণ নির্ভর করে পরিস্থিতি ও তাদের নীতি প্রস্তাবের উপর। যখন সরকার মুদ্রানীতিকে কঠোর করে তোলে কিংবা বিনিময় হারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তখন আইএমএফের আপত্তি জোরালো হয়। কিন্তু বাজার যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পড়ে যায় এবং সরকার সেই পতন নিয়ন্ত্রণে বাজার-সহায়ক ভূমিকা নেয়, তখন তারা চুপচাপ থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, "আইএমএফ কী বলল না বলল সেটি এখন আমরা মুখ্য বিষয় হিসেবে দেখছি না। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনা। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।"
সূত্রটি আরও জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে আরও ডলার কিনবে এবং বাজারকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।
ডলারের দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরো, পাউন্ড ও রিয়ালসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যেও পতনের লক্ষণ দেখা গেছে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মুনাফা ও ব্যয় কাঠামো নতুনভাবে হিসাব করতে বাধ্য হচ্ছে।
বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ইতিহাসে বিরল। একদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা, অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের সহজলভ্যতা—সব মিলিয়ে এখন দেশের হাতে ডলারের ঘাটতি নয়, বরং বেশি থাকা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে সক্রিয় হস্তক্ষেপ করে বাজারকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে এবং আইএমএফ এ বিষয়ে নীরব রয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে সরকার তার নীতিতে আত্মবিশ্বাসী। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রবণতা ধরে রাখতে হলে কৌশলী সমন্বয় ও পরিমিত বাজার নিয়ন্ত্রণের পথেই হাঁটতে হবে—নচেৎ ভবিষ্যতে আবার বিপরীতধর্মী চাপে পড়তে হতে পারে, তখন হয়তো আইএমএফ আবারও মুখ খুলবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ