
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা যেন থামছেই না। সর্বশেষ শনিবার (স্থানীয় সময়) সারাদিন ধরে চালানো একাধিক হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ১১০ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও বহু মানুষ। এসব তথ্য হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মী সূত্রে নিশ্চিত করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
এই নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। গাজা সিটির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিতর্কিত মানবাধিকার সংস্থা ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) পরিচালিত ওই ত্রাণকেন্দ্রের বাইরে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই অন্তত ৩৪ জন নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নিহতরা সবাই সেখানে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন, অনাহারে কাতর বহু মানুষ ওই সময় লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ গোলাগুলির শব্দে চারদিকে হাহাকার শুরু হয়। অনেকে ঘটনাস্থলেই মারা যান, বাকিদের মধ্যে অনেকে পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন।
এর পাশাপাশি আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে চালানো এক ভয়াবহ বিমান হামলায় নতুন করে বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এই শিবিরটি গাজা উপত্যকার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি, যেখানে ইতিমধ্যে হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের টার্গেট ছিল শিবিরটির মধ্যভাগ, যেখানে কয়েকটি পরিবার মিলে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছিল। এই হামলায় বহু শিশু ও নারী নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আহতদের স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলেও সেখানেও চলছে চরম বিশৃঙ্খলা ও ওষুধের তীব্র সংকট। হাসপাতালগুলোর আইসিইউ ও জরুরি বিভাগগুলো ইতিমধ্যেই ধারণক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
হামলার পর পরই হাসপাতালে থাকা এক চিকিৎসক জানান, “আমরা দিন-রাত মৃতদেহ গুনছি। প্রতিদিনই সংখ্যাটা বাড়ছে। শিশুদের লাশ প্যাকেটবন্দী করতে হচ্ছে। অনেক সময় বাবা-মা খুঁজে পাচ্ছেন না সন্তানের দেহ। এটা যেন এক মৃত্যুকূপ।”
গাজা শহরের বাসিন্দারা বলছেন, এখন ঘরে থাকার মতো নিরাপদ কোনো স্থান নেই। মসজিদ, স্কুল, শিবির—সবকিছুই ইসরায়েলের নিশানায় পরিণত হয়েছে। তারা জানান, প্রতিটি বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের কান্না, মানুষের আর্তচিৎকার এবং রক্তাক্ত লাশের দৃশ্য অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তাদের জীবনে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক আক্রমণ চালানোর পর থেকেই চলমান এই যুদ্ধের সূচনা হয়। হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ১,২০০ জন নিহত হয় এবং কয়েকশ ইসরায়েলিকে জিম্মি করে হামাস যোদ্ধারা। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে, যা দিন দিন আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
গত ৯ মাসে (অক্টোবর ২০২৩–জুলাই ২০২৫) ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত বোমাবর্ষণ ও অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৭ হাজার ৮৮২ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯৫ জন। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক রেডক্রস এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজায় ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের অভিযোগ তুললেও ইসরায়েল তাদের অভিযানের পক্ষে যুক্তি হিসেবে ‘হামাস নির্মূলের প্রয়োজনীয়তা’ দেখিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ সম্প্রতি জানিয়েছে, গাজা এখন ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিশু কবরস্থান’। প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ জন শিশু নিহত হচ্ছে। তাদের মতে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য—সব খাতই গাজায় ভেঙে পড়েছে। শিশুদের মনোজগতে তৈরি হচ্ছে চিরস্থায়ী ট্রমা, যা তাদের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক প্রভাব ফেলবে।
ইসরায়েলের এসব হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইসরায়েলের পক্ষে ভেটো প্রয়োগ করে প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু সদস্য ‘নির্বিচার হামলা’ বন্ধের আহ্বান জানালেও তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে এগোয়নি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে ইরান, তুরস্ক ও কাতার, এই হামলার নিন্দা জানিয়ে ইসরায়েলের ওপর অবরোধ আরোপের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু কার্যত গাজায় দিন দিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
গাজা এখন কেবল একটি ভূখণ্ড নয়—এটা একটি রক্তাক্ত অধ্যায়, একটি চলমান গণহত্যার প্রতিচ্ছবি। বিশ্বের চোখের সামনে দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি জনগোষ্ঠী, কিন্তু শান্তির পথে এখনও আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে না। এই হত্যাযজ্ঞের অবসান হবে কবে, কেউ জানে না। শুধু নিশ্চিত হচ্ছে একটাই বিষয়—এই যুদ্ধ ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যার একটি হিসেবে চিহ্নিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ