
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার মধ্যেও সরকারের ঋণের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চলতি অর্থবছর শেষে সরকারি মোট ঋণ দাঁড়াবে প্রায় ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের জাতীয় আয় বা জিডিপির প্রায় ৩৭ শতাংশের ওপরে। চলতি ঋণ ব্যবস্থাপনায় এই ঋণ বাড়তে থাকার ফলে অর্থনৈতিক সুশাসনে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে এলডিসি (কম আয়ের দেশ) থেকে উত্তরণের পর উচ্চ সুদে ঋণগ্রহনের আশঙ্কায় সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং রাজস্ব সংগ্রহের ওপর চাপ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
অর্থ বিভাগের সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শেষে দেশের মোট ঋণ দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় ঋণের পরিমাণ হবে প্রায় ১৩ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের অংশ দাঁড়াবে ১০ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সামনের দুই অর্থবছরে এই ঋণ আরও ৬ লাখ কোটি টাকার মতো বাড়তে পারে। অর্থাৎ ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ হবে ২৬ লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা ছাড়িয়ে যাবে ২৮ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকাও।
গত বছর অর্থবছরে সরকারের মোট ঋণ ছিল ১৮ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুরুতে অনুমান ছিল ২২ লাখ কোটি টাকার ওপরে, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেটি কিছুটা সংশোধন করে নামিয়েছে ২১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায়।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে সেটি কিছুটা কমিয়ে ৩৭.৪১ শতাংশে নামানো হলেও পরবর্তী অর্থবছরে ঋণের চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের নিজস্ব নীতিমালায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এই অনুপাত হবে ৩৭.৫০%, যা ধাপে ধাপে ২০২৭-২৮ অর্থবছরে পৌঁছাবে ৩৭.৭২ শতাংশে।
অর্থ বিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী, ঋণের মাত্রা এখনো সহনীয় সীমার মধ্যে থাকলেও ভবিষ্যতে ঋণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তখন ঋণ নিতে হবে উচ্চ সুদে, স্বল্প মেয়াদে, যা সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াবে।
মধ্যমেয়াদী নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিশোধ হয়েছে প্রায় ২০২ কোটি ডলার। আগামী অর্থবছরগুলোতে এই পরিমাণ বাড়বে ক্রমশ: ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২৬১ কোটি ডলার, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ২৯০ কোটি, ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ৩১২ কোটি এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৩৩৪ কোটি ডলারে পৌঁছাবে। সুদসহ এই ব্যয় আরও অনেক বেশি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি ঋণ বনাম রপ্তানির অনুপাত বর্তমানে প্রায় ১৪০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অর্থ বিভাগের মতে ঝুঁকিপূর্ণ। অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে এই ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ও অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নকে ঘিরে।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “অবশ্যম্ভাবীভাবেই পূর্বের সরকারের ঋণ বোঝা নিয়ন্ত্রণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমান সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে হবে, যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।” তিনি আরও বলেন,
“রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো না হলে, ঋণের ওপর চাপ বেড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।”
অর্থনীতিবিদ ড. রোকসানা ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ এখনো ঋণ ঝুঁকিতে তুলনায় নিরাপদে আছে, কিন্তু ঋণের বৃদ্ধির গতি ও পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনায় ভবিষ্যতে এটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো এবং বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ছাড়া ঋণের ভারসাম্য রক্ষা কঠিন।”
অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদ আতিকুল ইসলাম মনে করেন, “সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে এবং দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। তা না হলে ঋণভার চাপের কারণে উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির হার ৮ শতাংশের আশেপাশে। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এটি বাড়ানোর চাপ আরও বাড়বে। দেশের কর ভিত্তি সম্প্রসারণ ও ট্যাক্স কালেকশন বাড়ানো না গেলে রাজস্ব ঘাটতি থাকবে, যা ঋণগ্রহণের ওপর নির্ভরতা বাড়াবে।
সরকারের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বেশ কিছু কর ও শুল্ক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, তবে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে উন্নতির পথে থাকলেও ঋণ ব্যবস্থাপনা সংকট দিন দিন গভীর হচ্ছে। ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়লেও রাজস্ব সংগ্রহে জটিলতা এবং বৈদেশিক ঋণের সুদ ও পরিশোধের চাপ সরকারকে সংকটে ফেলতে পারে।
বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশকে উন্নয়নসহায়ক ঋণের সহজ শর্ত হারানোর আগাম সতর্কতা দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য দেশের অর্থনৈতিক নীতিতে সাবধানতা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও প্রগাঢ় সংস্কারের মাধ্যমে ঋণের টেকসই ব্যবস্থাপনা জরুরি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী সরকারের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে—রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি, দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা ও অগ্রাধিকার ভিত্তিক ব্যয় নিশ্চিত করা। ব্যতীত দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা ঋণের ভারে থমকে যেতে পারে, যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
সরকারি ঋণ দ্রুত বাড়ছে, তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো, ঋণের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি কমানো এখন সবচেয়ে জরুরি, না হলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন ঝুঁকিতে পড়বে। সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে অবিলম্বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ