
ছবি: সংগৃহীত
২০১৫ সালের ১৫ জুন ভুটানের থিম্পুতে চার দেশের—বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের—মোটর ভেহিকলস অ্যাগ্রিমেন্ট (এমভিএ) স্বাক্ষরিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল চার দেশের মধ্যে যান চলাচল বৃদ্ধি করে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংহতি গড়ে তোলা। চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, সদস্য দেশগুলো নিজেদের যানবাহন নিয়ে নির্বিঘ্নে সীমানা পেরিয়ে যেতে পারবে, একই সঙ্গে পণ্য পরিবহনে সহজলভ্যতা বাড়ানো হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক সংহতির স্বপ্ন দেখানো হয়।
কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও, সাধারণ মানুষের কাছে এই স্বপ্ন আজো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েনের কারণে এই চার-জাতি জোট বা ‘বিবিআইএন’ কার্যত স্থবির। বিশেষত, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পরিবর্তন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা পুরো প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
ভারতের ব্যর্থতা ও বিবিআইএন জোটের স্থবিরতা
২০১৪ সালে সার্ক সম্মেলনে ভারত নেপাল, বাংলাদেশ ও ভুটানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যানবাহনের মুক্ত চলাচল বিষয়ে চুক্তির প্রস্তাব দেয়। পাকিস্তানের আপত্তির কারণে সামগ্রিক সার্ক চুক্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে, ভারত এককভাবে চার দেশের ‘বিবিআইএন’ নামে একটি উপ-আঞ্চলিক জোট গড়ার উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু গত দশকজুড়ে দেখা গেছে, বিবিআইএন জোটে একরকম স্থবিরতা বিরাজ করছে। ভারতে যাত্রী ও পণ্যের চলাচলের ক্ষেত্রে সীমান্তে নানা প্রতিবন্ধকতা, পণ্য পরিবহনে শুল্ক ও কাগজপত্র জটিলতা থেকে মুক্তি নেই। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও অন্যতম কারণ ভুটানের সদস্য পদে দীর্ঘ সময় অনাগ্রহের। ভুটান ২০২৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলেও, কার্যত জোটের কার্যক্রম খুব ধীরগতিতে এগিয়েছে।
এরই মধ্যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মন্দার মুখে পড়ে। ২০২৩ সালের আগস্টে ‘ভারতপন্থি’ আখ্যায়িত সরকারের পতনের পর নয়াদিল্লি ঢাকা থেকে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং বাণিজ্যেও টানাপোড়েন দেখা দেয়। এর ফলে বিবিআইএন জোটের কার্যকারিতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
চীনের নবীন ‘চার-জাতি জোট’ এবং পাকিস্তানের ভূমিকাঃ দক্ষিণ এশিয়ার নতুন দৌড়
ভারতের এই ব্যর্থতা ও টানাপোড়েনের সুযোগ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ভিত্তিক ত্রিদেশীয় জোট সম্প্রতি তেজী পাচ্ছে। ২০১৫ সালে গঠিত এই ‘ত্রিদেশীয় স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ ফোরাম’ এখন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়নের ফলে পুনরায় সক্রিয় হচ্ছে।
২০২৫ সালের ১৯ জুন চীনের কুনমিং শহরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই ত্রিদেশীয় জোটকে ‘চার-জাতি জোট’ রূপ দেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশও এই জোটে সামিল হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পাকিস্তান এ ধরনের ছোট জোট গঠনকে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির ‘স্তম্ভ’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
চীনের অংশগ্রহণে এই নতুন জোটের লক্ষ্য শুধু কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমানো এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করাও। বিশেষ করে পাকিস্তান চায় বেইজিংয়ের মাধ্যমে ভারতকে ‘একঘরে’ হওয়া থেকে মুক্তি দিতে।
সার্কের পতন এবং বিকল্প জোটের আবির্ভাব
দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক গত কয়েক বছর ধরে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভারত ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্ক সম্মেলনে অংশ নেয়নি এবং এর ফলে সার্কের কার্যকারিতা ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়ে। ভারতের পরিবর্তে বিমসটেকের মতো অন্য আঞ্চলিক ফোরামের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার ফলে পাকিস্তান একঘরে হয়ে পড়ে।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও চীন সার্কের বিকল্প হিসেবে নতুন ছোট ছোট জোট তৈরিতে উদ্যোগী হয়। বিশেষত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তানের মধ্যে রেলপথ প্রকল্পসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এই কৌশলগত জোট রাজনৈতিক বিরোধ কমাতে ও আঞ্চলিক সংহতি বাড়াতে কাজ করছে।
ভারতের উদ্বেগ ও নিরাপত্তার প্রভাব
ভারত ইতিমধ্যেই এই সম্ভাব্য নতুন ‘চার-জাতি জোট’কে নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশটির চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল অনীল চৌহান ৯ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেন, চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশ জোট ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
ভারতের জন্য এই জোট শুধু কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নয়, এর ফলে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ভারসাম্য ধ্বংস হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
চীনের সক্ষমতা ও ভারত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
ভারতের ‘বিবিআইএন’ জোট গঠনে প্রায় দশক ধরে ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে—চীন কি দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একটি জোট গড়তে পারবে যা কার্যকর ও স্থায়ী হবে? ভারতের ব্যর্থতা থেকে চীন কতটা শিক্ষা নিয়েছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারত থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে চলেছে। প্রথমত, আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে ধারাবাহিক এবং সম্মানজনক কূটনীতি প্রয়োগ। দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সফট পাওয়ার ব্যবহার।
তবে, দক্ষিণ এশিয়ার ভিন্ন ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিলতা চীনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনশীল এবং ভারতের প্রতি মনোভাবও প্রভাব ফেলতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত ঐক্য ও বিভাজন
দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাব ও দ্বিপাক্ষিক তিক্ততার কারণে ভারতের নেতৃত্বাধীন ‘বিবিআইএন’ ধীরগতি ধারণ করেছে। ভারতীয় কূটনীতির ব্যর্থতার কারণে আঞ্চলিক সংহতি তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, চীন-পাকিস্তান ভিত্তিক নতুন ‘চার-জাতি জোট’ গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে ভারত ও অন্যান্য দেশ উদ্বিগ্ন। তবে এটি কতটা সফল হবে, তা দেশগুলোর রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল।
সুতরাং, দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সহযোগিতা বৃদ্ধি। নতুন জোটগুলো কি আসলেই দক্ষিণ এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে, নাকি এর ফলে বিভাজন আরও গাঢ় হবে, তা সময়ই দেখাবে।
এমন কঠিন রাজনৈতিক ভূ-রাজনীতির মধ্যে ভারতের ‘ব্যর্থতা’ থেকে শিক্ষা নিয়ে চীনের কৌশল কতটা সফল হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ