
ছবি: সংগৃহীত
ইসরাইলি অবরোধে চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। টানা ১০৩ দিন ধরে চলছে অঞ্চলটির পূর্ণ অবরোধ—যার ফলে খাদ্য, পানি, ওষুধ, জ্বালানি এমনকি মানবিক সহায়তাও গাজার বাসিন্দাদের কাছে পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় গাজা প্রশাসন এক জরুরি বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছে, উপত্যকার অন্তত ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু চরম অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ১২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ দুর্বিষহ ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার শিকার হয়ে জীবনযাপন করছে।
শনিবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে গাজার প্রশাসনের জারি করা বিবৃতি উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘‘গাজায় আমরা এক নির্মম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের শিশু, আমাদের মা-বোনেরা, অসুস্থ ও বৃদ্ধরা চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে।’’
গাজার প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, অবরোধের ফলে অঞ্চলটির সব প্রবেশপথ—বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ রাফাহ ও কারেম শালোম সীমান্ত ক্রসিংগুলো—ইসরাইলি বাহিনী একতরফাভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো কোন ধরনের খাদ্য, ওষুধ বা অন্যান্য জরুরি পণ্য গাজায় প্রবেশ করাতে পারছে না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘‘এটি আধুনিক কালের অন্যতম ভয়াবহ সমষ্টিগত অবরোধ। এই অবরোধ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মানবিক আইন লঙ্ঘন করছে। অথচ বিশ্বের নেতৃত্বসীমা এমন এক লজ্জাজনক ও অমানবিক নীরবতা পালন করছে, যা একধরনের নৈতিক ব্যর্থতা ও সহাবস্থানমূলক অপরাধের সমতুল্য।’’
গাজা প্রশাসন জানিয়েছে, শুধু গত তিন দিনেই খাদ্য ও ওষুধের অভাবে বহু মানুষ মারা গেছেন, যাদের বেশিরভাগই শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগে আক্রান্ত অসহায় মানুষ। এখন পর্যন্ত ৬৭ জন শিশু শুধু অপুষ্টি ও অনাহারে মারা গেছে—এই সংখ্যাটি দিনে দিনে বাড়ছে।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষত রাফাহ অঞ্চলে, পরিস্থিতি আরও শোচনীয়। এই এলাকা থেকেই ইসরাইলি বাহিনী গাজায় ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ দিত—সেই পথও গত এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ। এখন আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই চরম খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে আরও বহু শিশুর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, সংকট কেবল ত্রাণের ঘাটতিতেই সীমাবদ্ধ নয়—বিদ্যুৎ ও পানির অভাব, ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, দগ্ধ-আহতদের চিকিৎসার সুযোগ না থাকা এবং ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্ব মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে কিছু নির্দিষ্ট মহল থেকে। যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির অন্তত ৬০ জন সংসদ সদস্য বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামিকে একটি যৌথ চিঠি পাঠিয়েছেন। এই চিঠিতে তারা গাজায় চলমান ‘জাতিগত নিধন’ অবিলম্বে বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
‘লেবার ফ্রেন্ডস অব ফিলিস্তিন অ্যান্ড দ্য মিডল ইস্ট’-এর উদ্যোগে তৈরি হওয়া এই চিঠিতে মধ্যপন্থি ও বামঘরানার এমপিরা স্বাক্ষর করেছেন। তারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, এবং অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও ত্রাণ প্রবেশ নিশ্চিত করা হোক।
চিঠিতে গাজার রাফাহ সীমান্তের ধ্বংসস্তূপে ‘ত্রাণ কেন্দ্র’ গড়ে তোলার নামে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের সামরিক পরিকল্পনারও তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। এমপিরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘রাফাহতে ইসরাইলের নতুন তাবু শহরের পরিকল্পনা কার্যকর হলে, তা কার্যত ফিলিস্তিনি জনগণকে জোরপূর্বক স্থানান্তর এবং তাদের উপস্থিতি মুছে ফেলার উদ্যোগে পরিণত হবে, যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ।’’
জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাও গাজায় অবিলম্বে মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি না দিলে ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষের’ আশঙ্কার কথা জানাচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অবরোধ, শিশুদের মৃত্যুর মিছিল এবং আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তা একটি গভীর নৈতিক ও মানবিক সংকটকে প্রতিফলিত করে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে, গাজা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্মম মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্র হয়ে উঠবে—যার দায় পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এড়াতে পারবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ