
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় ত্রাণ নিতে গিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে নিহত হয়েছে প্রায় ৮০০ জন, যেখানে চলছে ভয়াবহ খাদ্যাভাব, চিকিৎসা সংকট ও ইসরায়েলের মারাত্মক বিমান হামলা। মানবিক সংকট ও রক্তাক্ত গণহত্যার এই চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে সারা উন্মুক্ত হলেও, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এ ঘটনাকে থামাতে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না; বরং ইসরায়েলকে অস্ত্র ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করছে।
গত শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (ওএইচসিএইচআর) জানায়, গত মে মাসের শেষ থেকে জাতিসংঘের নিষেধ সত্ত্বেও গাজায় ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) নামে একটি বিতর্কিত সশস্ত্র গোষ্ঠী ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। এই সংগঠন গড়ে তুলেছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। তাদের গুলিতে ত্রাণ নিতে আসা প্রায় ৮০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। শুক্রবারও ১০ জনকে হত্যা করা হয় এবং অন্তত ৬০ জন আহত হয়েছে।
ত্রাণ ও চিকিৎসা সংকটে মৃত্যু বৃদ্ধির পেছনে এই গুলির ভয়াবহ ভূমিকা রয়েছে। ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি বলেন, “গাজা এখন শিশু ও ত্রাণ প্রত্যাশীদের জন্য এক বিশাল কবরস্থান। ইসরায়েলের বর্বরতা এখানকার জীবনকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।”
বিশ্বের চিকিৎসক সংগঠন ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডার’ও জানায়, গাজায় পুষ্টিহীনতার মাত্রা নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। খান ইউনিসে আল নাসের হাসপাতালের শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান আহমেদ আল ফারা বলেছেন, ইসরায়েলের বিমান হামলায় হাসপাতালে অনেক আহত আনা হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম তীব্র সংকটে।
গৃহহীন মানুষের ওপর আবারো হামলা
ইসরায়েল গাজার প্রায় সমস্ত ভবন ধ্বংস করায় হাজার হাজার বাসিন্দা তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও তারা হামলা চালাচ্ছে। দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের আল মাওয়াসি এলাকায় গত শুক্রবার ইসরায়েলের সেনারা তাঁবু গুঁড়িয়ে মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে। গৃহহীন ও হতাশ বাসিন্দারা গণমাধ্যমে ছবি-ভিডিওতে বসে থাকতে দেখা যায়।
দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের অবসান
ইসরায়েলের সাংবাদিক গিডিয়ন লেভি জানান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর আলোচনায় দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ‘মৃত ও সমাহিত’ ঘোষণা পেয়েছে। ট্রাম্পের ভাষায়, “ফিলিস্তিনিদের নিজেদের শাসনের ক্ষমতা থাকা উচিত, তবে ইসরায়েলের নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি সব সময় আমাদের হাতে থাকবে।”
লেভি বলেন, “ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কোনো সম্ভাবনা নেই যতক্ষণ দখলদারি ও বসতি স্থাপন অব্যাহত থাকবে। আমাদের নতুন ধারণায় ভাবতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইসরায়েলের ‘নিখুঁত অপরাধ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরদারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অকপট সমর্থনে ইসরায়েল দমন-পীড়ন চালিয়ে ‘নিখুঁত অপরাধ’ করে যাচ্ছে। কাতারের দোহা ইনস্টিটিউটের তামের কারমাউত বলেন, “আমাদের চোখের সামনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে নিখুঁত অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না থাকলে এই যুদ্ধ অনেক আগেই শেষ হতো। এটি অত্যন্ত সু-সমন্বিত যুদ্ধ।”
গাজা: এক বিশাল কবরস্থান
গাজার অবরুদ্ধ উপত্যকায় খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিদ্যুতের সংকট চলছে। শিশু ও অসহায় মানুষের মৃত্যু বাড়ছে ধীরে ধীরে, গুমরে গুমরে। স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, শৈশব পুষ্টিহীনতা এখন ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। বিমান হামলা, অবরোধ ও গুলিতে নিরীহ মানুষ প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে।
গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের মোকাবিলা না করে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের খাতিরে এই সংঘাতকে লম্বা করায় ফিলিস্তিনি জনগণের দুঃখ-দুর্দশার অবসান দৃষ্টির আড়ালে পড়ে গেছে।
সংক্ষিপ্ত তথ্যাবলী:
গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলিতে ৮০০-এর বেশি নিহত।
জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত মে থেকে গাজায় জিএইচএফ নামে বিতর্কিত গোষ্ঠী ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ইসরায়েলের বিমান হামলা ও অবরোধে চিকিৎসা ও খাদ্যের তীব্র সংকট।
দক্ষিণ গাজায় বাস্তুচ্যুতদের নিরাপদ আশ্রয়ে হামলা।
মার্কিন-ইসরায়েলি নেতৃত্ব দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের অবসান ইঙ্গিত দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবহেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে গাজায় নিখুঁত অপরাধ চলছে।
শিশু ও অসহায়দের মৃত্যু বাড়ছে, পুরো গাজা এক বিশাল কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
গাজার মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ