
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাম্প্রতিক অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, আন্দোলন ও কর্মবিরতির জেরে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থার পরিসর আরও বড় হয়েছে। বদলির আদেশ অবজ্ঞা করে প্রকাশ্যে তা ছিঁড়ে ফেলা, আন্দোলনের সময় অসদাচরণ এবং রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে এবার আরও ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে এনবিআর সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো থেকে মোট ২৯ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত অথবা বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো।
এনবিআরের বোর্ড প্রশাসন বিভাগ থেকে পাঠানো সর্বশেষ চিঠি অনুযায়ী, বদলির আদেশ প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলায় আয়কর ও কাস্টমস বিভাগের সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কর পরিদর্শক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, প্রধান সহকারী এবং সিপাই পদে কর্মরতরা। এই বরখাস্তের সিদ্ধান্ত এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনে দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কর ও কাস্টমস প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, এনবিআরের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপে কটূক্তি করার অভিযোগে কর অঞ্চল-১০-এর নিরাপত্তা প্রহরী মো. সেলিম মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব ও উপকর কমিশনার মুকিতুল হাসানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপনীয় দলিল ফাঁসের অভিযোগে। এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর সংশ্লিষ্ট ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যক্রম শুরুর জন্য তদন্ত চলছে। বরখাস্তকালীন তিনি খোরপোশ ভাতা পাবেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমানকেও একই অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগে এর আগে আরও ১৪ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই তালিকায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের শীর্ষ নেতৃত্বও রয়েছেন—যেমন সভাপতি অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এবং সহসভাপতি মীর্জা আশিক রানা। এছাড়া জুলাইয়ের শুরুতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারসহ আরও চার কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
সাম্প্রতিক আন্দোলন ও শাটডাউন কর্মসূচির কারণে জাতীয় রাজস্ব আদায়ে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তার পরিমাণ নিরূপণে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি ৯ সদস্যবিশিষ্ট আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) শুল্ক-২ শাখা থেকে গতকাল অফিস আদেশ জারি করা হয়।
কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে আইআরডির যুগ্ম সচিব সৈয়দ রবিউল ইসলামকে এবং সদস্য সচিব হলেন আইআরডির প্রশাসন-১ শাখার উপসচিব। কমিটিতে আরও রয়েছেন অর্থ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিজিএমইএ এবং এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিরা।
এই কমিটি মূলত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বন্ধ থাকার সময়ের রাজস্ব ক্ষতির হিসাব নির্ধারণ করবে। শুধু বন্দর নয়, কর্মবিরতির প্রভাব দেশজুড়ে অন্যান্য কাস্টমস, ভ্যাট ও কর অফিসেও পড়েছে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই এনবিআর সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এনবিআর প্রশাসন মনে করছে, এ ধরনের অসাংবিধানিক এবং দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে রোধে এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল।
বছরের শুরু থেকেই এনবিআরের অভ্যন্তরীণ সংস্কার দাবিকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে কর্মবিরতি, কালো ব্যাজ ধারণ, শাটডাউন কর্মসূচি ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অসন্তোষ প্রকাশের ঘটনা ঘটে। এর জেরে করসেবা ও বন্দর কার্যক্রম ব্যাহত হয়, যার কারণে অর্থনীতিতে লক্ষণীয় চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা, সরকার এনবিআরের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং চলমান রাজস্ব সংগ্রহব্যবস্থাকে সচল রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, যার ফলস্বরূপ একের পর এক শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত আসছে। তবে এনবিআরের বিভিন্ন স্তরে এই শাস্তিকে ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, তা নির্ভর করবে আন্দোলনের লাগাম কতটা টেনে ধরা যায় এবং সরকারি তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য হয় তার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ