
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ‘জেড’ ক্যাটাগরিভুক্ত, অর্থাৎ জাঙ্ক কোম্পানির সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, যা দেশের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ডিএসইতে ৯৯টি কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রয়েছে, যা ‘বি’ ও ‘এন’ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। এই পরিস্থিতি বাজারের স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিএসইতে কোম্পানিগুলোকে কার্যক্রম, লভ্যাংশ প্রদান ও পরিচালনাগত দিক বিবেচনায় চারটি ক্যাটাগরিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়—‘এ’, ‘বি’, ‘এন’ ও ‘জেড’।
‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো প্রতি বছর ১০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ প্রদান করে এবং নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজন করে।
‘বি’ ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলো ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেয়।
নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো ‘এন’ ক্যাটাগরিতে থাকে।
যেসব কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করে না এবং লভ্যাংশও দেয় না, তাদের ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত করা হয়। এই ক্যাটাগরির কোম্পানিগুলোকে সাধারণত ‘জাঙ্ক কোম্পানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
অর্থবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে কোম্পানির অতিরিক্ত বৃদ্ধি পুঁজিবাজারের লেনদেন কমার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি। যেকোনো কোম্পানি ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পড়লে তার শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের ঋণ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায় এবং লেনদেন নিষ্পত্তি সময় তিন দিন পর্যন্ত বেড়ে যায়, যা স্বাভাবিক চেয়ে বেশি। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য এই শেয়ারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
একাধিক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন, তারা পূর্বে এমন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলেন যেগুলো ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের শেয়ার ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরিত হয়ে দরপতন শুরু হয়, ফলে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে।
বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে থাকা কোম্পানির তালিকায় রয়েছে নেটওয়ার্কস, অ্যাকটিভ ফাইন, এএফসি এগ্রো বায়োটেক, আলিফ মেনুফ্যাকচারিং, আরামিট সিমেন্ট, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি, মেঘনা কনডেন্স মিল্ক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ওরিয়ন ফার্মা, প্রাইম টেক্স, রিজেন্ট টেক্সটাইল, সাভার রিফ্যাক্টরিজ, সোনালী লাইফ, ইউনিয়ন ব্যাংক, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডসহ শতাধিক কোম্পানি অন্তর্ভুক্ত। অধিকাংশের শেয়ার দর ১০ টাকার নিচে এবং অনেকের দাম ৫ টাকার নিচে নেমে গেছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে গেছে এবং বাজার থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, “জেড ক্যাটাগরির বিষয়টি পুরোপুরি স্টক এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রণে। কোম্পানি কোন কারণে জেড ক্যাটাগরিতে থাকবে, সেটি আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী ডিএসই নির্ধারণ করে। তবে ডিভিডেন্ড ঘোষণা করার পরও তা বিতরণ না করলে কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে পাঠানোর বিধান কঠিন। এই বিষয়ে ডিএসই কমিশনের কাছে প্রস্তাব দিতে পারে এবং কমিশন বিবেচনা করবে।”
অন্যদিকে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে বাজারের বিভিন্ন অংশীজন এবং স্টক এক্সচেঞ্জ খারাপ কোম্পানি তালিকাভুক্তির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের কথা শুনেনি। তার ফলশ্রুতিতে আজ শতাধিক কোম্পানি জেড শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইপিও নীতিমালা ও বাজার নিয়ন্ত্রণে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।”
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির সংখ্যা বাড়া মূলত বাজারের স্বাস্থ্যের গুরুতর সংকেত। এসব কোম্পানি দুর্বল পরিচালনা, আর্থিক অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাবের কারণে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বাজারের টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব কোম্পানির ব্যাপক পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।”
অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগ পরামর্শক রুমানা আক্তার বলেন, “বিনিয়োগকারীদের সচেতন হওয়া উচিত, এবং শুধুমাত্র ভালো রেটিং ও দৃঢ় আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা উচিত। নীতি নির্ধারকদের আরও কড়া পদক্ষেপ নিয়ে বাজারের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে হবে।”
বর্তমানে ‘জেড’ ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন এবং তাদের আস্থা কমে গেছে। বাজারের স্বাভাবিক গতিপথ ফিরে পেতে হলে দরকার রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর মনিটরিং, দুর্বল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি।
এছাড়া বিনিয়োগকারীদেরও দরকার বাজারের সঠিক জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া। অতি উৎসাহ বা দ্রুত লোভের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে বিনিয়োগ করলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বর্তমানে জাঙ্ক কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংকটের সমাধান ছাড়া দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন কঠিন হবে, যা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে এখনই প্রয়োজন কার্যকর নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ