
ছবি: সংগৃহীত
দুর্বল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির চাপ এবং ক্রমবর্ধমান বাজেট ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক ধরনের স্থবিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বুধবার (১৬ জুলাই) প্রকাশিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে অর্থনীতির সার্বিক গতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি, মুদ্রানীতির প্রভাব, রাজস্ব ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সরকারের ব্যয় কাঠামো নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটি এমন এক সময়ে প্রকাশিত হলো, যখন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথ অতিক্রম করছে দেশ। সাধারণত প্রতি অর্থবছরের শেষে ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলেও এবার সরকারের বদল, পরিসংখ্যানগত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বিলম্ব এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের জটিলতা ইত্যাদি কারণে প্রতিবেদন প্রকাশে প্রায় এক বছরের দেরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সবচেয়ে বড় তিনটি চ্যালেঞ্জ ছিল—দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ, নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি এবং বাজেট ঘাটতির উচ্চ প্রবণতা। এই তিনটি কারণই সমষ্টিগতভাবে দেশের অর্থনীতিকে এক ধরনের স্থবিরতায় ফেলে দিয়েছে। এ অবস্থার ফলে অর্থনীতির স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক বছর ধরেই রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হচ্ছে। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে কর কাঠামোয় ছাড় দেয়। তবে এর প্রভাবে রাজস্ব ঘাটতি আরও বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে মন্দার কারণে ভ্যাট ও কর আদায় হ্রাস পায়।
ফলে সরকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারেনি। এতে বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প থেমে যায় বা ধীরগতিতে অগ্রসর হয়। প্রতিবেদন বলছে, এই অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে এবং ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
উন্নয়ন ব্যয় চালাতে গিয়ে সরকার অধিকহারে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করে, যা বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে দেয়। এতে একদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হয়, অন্যদিকে উচ্চ সুদের কারণে সরকারের ঋণ পরিশোধের ব্যয়ও বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, সরকারি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপর তা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। বিগত তিন অর্থবছর ধরে দেশে চড়া মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ ভোক্তারা বিপাকে পড়েছেন। যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে শুরু করেছে, তবে তা এখনো স্বস্তিদায়ক মাত্রায় পৌঁছায়নি।
বার্ষিক প্রতিবেদনে আশার কথাও বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত বছরের আগস্টে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রার সচেতনতা দেখা গেছে। অপচয় কমাতে নেয়া হয়েছে কঠোর পদক্ষেপ। এর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সরকারের ব্যয়-সংশ্লিষ্ট এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ইতোমধ্যে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ফলে ব্যাংক খাতে কিছুটা তারল্য ফিরেছে, যা আগামীতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এতে উৎপাদনশীল খাতে কার্যক্রম বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে আয় বাড়বে।
প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীনে সরকার পরিবহণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। এই বিনিয়োগের ফলে উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমের পরিধি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা ও যমুনা নদীর ওপর নির্মিত রেলসেতু চালু হওয়ার ফলে দক্ষিণ, উত্তর এবং পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি এসেছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, এই অঞ্চলে আরও অর্থনৈতিক অগ্রগতি আনতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিনিয়োগবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ এবং নীতিগত সহায়তা জরুরি।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য পূর্বাভাস দিতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, যদি বর্তমান সরকারের ব্যয় সচেতনতা ও বিনিয়োগ উদ্যোগ অব্যাহত থাকে, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতি স্থিতিশীলতার পথে ফিরতে পারে। তবে রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ করতে হবে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং বাজেট ঘাটতি কমাতে বহুমুখী উৎস থেকে অর্থায়নের পরিকল্পনা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন দেশের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, দুর্বলতা ও সম্ভাবনার এক পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করেছে। প্রতিবেদনে যেমন সতর্কতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে আশাবাদের ইঙ্গিতও। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গতিপথ সঠিক থাকলে, আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরায় গতি ফিরে পেতে পারে—এমনটাই মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এর জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, শক্তিশালী রাজস্ব ব্যবস্থা এবং কার্যকর বিনিয়োগ পরিবেশ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ