
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরাইলের অব্যাহত সামরিক আগ্রাসনে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের মিছিল। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর ভয়াবহ বোমা হামলায় আরও অন্তত ৯৪ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫২ জন। এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই একতরফা যুদ্ধে গাজায় নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার ৬০০-তে, যা মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার রেকর্ড গড়ছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজার বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে নতুন করে আরও ৯৪ জন নিহতের মরদেহ আনা হয়েছে। একই সময় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ২৫২ জন।
তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসনে মোট ৫৮ হাজার ৫৭৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬০৭ জন। তবে এই সংখ্যাও সম্পূর্ণ চিত্র নয় বলে আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো বহু মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে এবং রাস্তায় পড়ে থাকলেও সেগুলো উদ্ধার করা যাচ্ছে না। ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত গোলাবর্ষণ এবং নিরাপত্তা সংকটের কারণে উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারছেন না।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ইসরাইল হামলার ধরন পাল্টে ফেলেছে। এখন তারা শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, এমনকি রাস্তায় চলা নিরীহ ফিলিস্তিনিদেরও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়, শুধুমাত্র গত ২৪ ঘণ্টায় মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে ইসরাইলি ড্রোন ও গুলি হামলায় নিহত হয়েছেন ৭ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। অথচ তারা আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। এর আগে ২৭ মে থেকে এ পর্যন্ত এই ধরনের মানবিক সহায়তা নিতে গিয়ে হামলায় নিহত হয়েছেন ৮৫১ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ৫ হাজার ৬৩৪ জন ফিলিস্তিনি।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইল ও হামাস সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও, তা বেশিদিন টেকেনি। গত ১৮ মার্চ ইসরাইল ওই যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে আবারও পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করে গাজা উপত্যকায়। এর পরবর্তী সময়েই সবচেয়ে ভয়াবহ মাত্রায় হামলা শুরু হয়, যেখানে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭ হাজার ৭৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ২৭ হাজার ৫৬৬ জন আহত হয়েছেন।
যুদ্ধ শুরুর পর প্রায় এক বছর হতে চললেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর কোনো হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর আহ্বান সত্ত্বেও ইসরাইল আগ্রাসন বন্ধ করেনি। বরং হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মীয় উপাসনালয় এমনকি শিশু ও নারীদেরও নিশানা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গাজার জনগণ এখন একপ্রকার মৃত্যুপ্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন।
গাজায় এখন খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও চিকিৎসাসেবা—সবকিছুর তীব্র সংকট চলছে। প্রায় প্রতিটি হাসপাতাল বোমায় বিধ্বস্ত বা চিকিৎসা উপকরণের অভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে শত শত মানুষ খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে।
গোটা গাজা কার্যত এক বড় কবরখানায় পরিণত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষদের আর বাঁচানো যাচ্ছে না, শিশুরা পানির অভাবে মারা যাচ্ছে, আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সীমিত বিবৃতি দিয়ে দায় সারছে।
গাজায় ইসরাইলের এই অব্যাহত গণহত্যা এখন শুধু একটি যুদ্ধ নয়, বরং মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাতিগত নির্মূলের ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় বিশ্ব মানবতার পক্ষ থেকে শক্ত ও সুস্পষ্ট অবস্থান না নিলে গাজার পরিণতি হবে ইতিহাসের কলঙ্কজনক এক অধ্যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ