
ছবি: সংগৃহীত
চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন ঢাকার ওপর ভিন্ন মাত্রার চাপ তৈরি করেছে। বাণিজ্যিক আলোচনার আড়ালে নিরাপত্তার মোড়কে উঠে আসছে ভূরাজনৈতিক আগ্রাসনের ইঙ্গিত। সম্প্রতি ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা এই বাস্তবতার আরও একটি প্রমাণ।
যেখানে আলোচনার আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য ছিল শুল্ক ও বাণিজ্যিক ভারসাম্য, সেখানে অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বারবার চীনের প্রতি বাংলাদেশের অবস্থান, চীনা সফটওয়্যারের ব্যবহার, সামরিক ও বেসামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা এবং বিভিন্ন চীনা প্রযুক্তিগত সংযোগ নিয়ে সরব হয়েছে। আলোচনার অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন বাংলাদেশের ওপর বেশ কিছু স্পষ্ট ও কঠিন শর্ত চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।
প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি ছিল চীনের ‘ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস পাবলিক ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্ম’, যা বিশ্বব্যাপী ‘লগইংক’ নামে পরিচিত। এটি একটি জাহাজ ট্র্যাকিং ও পণ্য পরিবহন তথ্য ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার, যা ২০০৭ সালে চীন তৈরি করে। ২০১০ সালে এটি ‘নীল-নেট’ (Northeast Asia Logistics Information Service Network)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ অনেক বন্দরেই এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে চাইছে, বাংলাদেশ যেন তার কোনো বন্দর, টার্মিনাল বা বাণিজ্যিক নৌযানে এই সফটওয়্যার ব্যবহার না করে। ওয়াশিংটনের দাবি, এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে চীন তাদের গোয়েন্দা নজরদারি চালাতে পারে, যা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। ফলে তারা চায়, বাংলাদেশ ‘লগইংক’ থেকে সরে এসে বিকল্প সফটওয়্যারে নির্ভর করুক, যা যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের মিত্র দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সূত্র বলছে, আলোচনা যতটা না শুল্ক বা বাণিজ্য ভারসাম্য নিয়ে, তার চেয়ে বেশি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশল নিয়ে। বাংলাদেশের উপর প্রত্যক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে বলা হয়েছে, যেসব চীনা সফটওয়্যার, পণ্য বা সরবরাহ ব্যবস্থা মার্কিন নিরাপত্তার জন্য হুমকি—তাতে বাংলাদেশ যেন অংশ না নেয়।
এমনকি বাংলাদেশের শুল্ক ও রপ্তানি ব্যবস্থার ভেতরে ঢুকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রয়োগ করতে চায়। বাংলাদেশকে বলা হয়েছে, তারা যেন মার্কিন ‘বিওআইএস’ (Bureau of Industry and Security) ছাড়পত্র ছাড়া কোনো অননুমোদিত পণ্য আমদানি বা পুনঃরপ্তানি না করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে বলা হয়েছে, যার মধ্যে তদন্ত, নিরীক্ষা ও দণ্ডের ক্ষমতা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনা কমিয়ে দিক। এর পরিবর্তে তারা নিজস্ব সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি বেসামরিক উড়োজাহাজের ক্ষেত্রেও তারা চীনা প্রস্তুতকারীদের পরিবর্তে মার্কিন কোম্পানিগুলোর পক্ষ নিয়েছে। সয়াবিন তেল, গম এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানির ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র তাদের সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন রপ্তানি আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে একটি বড় পরিসরের যৌথ সাইলো নির্মাণের প্রস্তাবও দিয়েছে তারা, যাতে মার্কিন সয়াবিন দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা যায়।
এই আলোচনায় বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি কিছু না বললেও, অভ্যন্তরীণভাবে অসন্তোষ স্পষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র কার্যত চাপ প্রয়োগ করছে। বাংলাদেশ কোন দেশের সঙ্গে কী বাণিজ্য করবে, সেটা সম্পূর্ণভাবে আমাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশের বাণিজ্যিক নীতিনির্ধারণ যেন তাদের নিরাপত্তা চিন্তা অনুসারে হয়। তারা বারবার চীনকে কেন্দ্র করেই কথা বলছে।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় একদিকে শুল্ক ও বাণিজ্য উন্নয়নের কথা বলছে, অন্যদিকে ভূরাজনৈতিক এক স্ট্র্যাটেজি চাপিয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে বুঝে শুনে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এমন কোনো সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না, যা আমাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাধীন নীতিমালাকে বাধাগ্রস্ত করে।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্য সম্পর্ক, তা হঠাৎ করে ছিন্ন করা সম্ভব নয়। চীন আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তারা আমাদের শতভাগ শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিয়েছে। এ ধরনের সম্পর্কের বিকল্প তৈরি ছাড়া কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়।”
আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “দরকষাকষি এখনও চলমান। আমি এখনই কিছু বলতে চাই না। এটা এমন একটি বিষয় যেখানে আমি কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাই না।”
তিনি আরও বলেন, “নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট থাকতেই পারে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অবগত। আমি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে আগ্রহী নই।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে আরও কঠিন কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার মাঝখানে অবস্থান করেও কৌশলীভাবে নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা—এই তিনটিকে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করে অগ্রসর হওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বিচক্ষণ পথ।
বিশ্ব রাজনীতির নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এখন আর কেবল অর্থনীতি নয়, নিরাপত্তা ও কৌশলগত ভারসাম্যের বিষয়ও হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ