
ছবি: সংগৃহীত
গত বছর দেশের ইতিহাসের এক গোপন এবং বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হলো জুলাই মাস। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অসংখ্য নারী, শিশু ও যুবক। এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়েছে, কিন্তু শহীদদের পরিবারের দুঃখের ক্ষত এখনও শুকায়নি। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণায় তারা এখনও কাটাতে পারছেন না। স্বজনদের কান্না, অসমাপ্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা আর জীবনযুদ্ধে ছেড়ে যাওয়া গল্পগুলো আজও নতুন করে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
সোয়াইবার জীবন, মায়ের স্মৃতি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত
সোয়াইবার বয়স এখন ১৪ মাস পার, অথচ সে বলার আগেই নীরবতা শিখেছে, হাঁটার আগে জীবনের ভার বইছে। গত বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর চিটাগং রোডের এক ভাড়া বাসায় মা সুমাইয়া আক্তারের (২০) ওপর গুলি চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। তখন সোয়াইবা ছিল মায়ের কোলে, এখন সে বড় হচ্ছে নানির কোলেই। বাবা থেকেও বঞ্চিত সে, যিনি স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেয়ের খোঁজই নিচ্ছেন না।
আসমা খাতুন, সোয়াইবার নানি, কণ্ঠে সামলাতে না পারা কষ্ট নিয়ে বলেন, “আমার বুকে যেন পাথর বসে আছে। আমার মেয়েকে হারিয়েছি, তার ছোট্ট মেয়েকে আমি বড় করছি, কিন্তু আমি মা নই। মায়ের আদর, বুকের গন্ধ আমি দিতে পারি না। সোয়াইবা মাঝরাতে কাঁদে, মাকে খোঁজে, আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারি না।”
আসমা খাতুন সরকারের প্রতি আবেদন জানান, যেন সোয়াইবার জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যত তৈরি করা হয়।
রিয়া গোপ: ছাদ থেকে গুলির নিশানায় মৃত্যু
নারায়ণগঞ্জের নয়ামাটির একটি বাড়ির ছাদে খেলছিল ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপ। গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে হঠাৎ থেমে থেমে আসা গুলির আওয়াজের মধ্যে বাবা দীপক গোপ মেয়েকে আনতে ছাদে যান। কোলে নেয়া মাত্র গুলি লাগে রিয়ার মাথায়, আর সে নিথর হয়ে পড়ে বাবার বুকেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হলেও ২৪ জুলাই সে মারা যায়।
রিয়ার মা বিউটি ঘোষ ঘর থেকে বের হতে পারেন না, কারো সঙ্গে কথা বলতে চান না। চোখের জলে দিন শুরু ও শেষ হয়। বাবা দীপক গোপ বলেন, “মেয়েকে হারানোর পর বেঁচে থাকা যেন বোঝা হয়ে গেছে। সত্যটা মানতে পারছি না।”
নাঈমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ও অসীম শূন্যতা
গত বছরের ১৮ জুলাই নিহত হন উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী নাঈমা সুলতানা। বাড়ির বারান্দায় মোবাইলে ভিডিও করার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এবার তার ১৮তম জন্মদিন। পরিবারের কোনো খুশির পাল্লা ভারী নয়, বরং চোখে জল আর শূন্যতা।
মা আইনুন নাহার বলেন, “আজ আমার মেয়ের এসএসসির ফল দেওয়ার দিন ছিল। হয়তো সে খুশিতে বলে দিত– মা, আমি গোল্ডেন পেয়েছি। কিন্তু সে নেই।” কান্নায় ভেঙে পড়া আইনুন বলতে থাকেন, “বুকের ভেতরটা প্রতিদিন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আজ কবরের পাশে বসে শুধু বলেছি– তুই খুব ভালোবাসার মেয়ে ছিলি।”
নাঈমার বড় বোন তাসফিয়া সুলতানা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। বোনের স্মৃতিতে ভরা বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না তিনি।
জাবিরের বিদায়: পরিবারের ভাঙন
জাবির ইব্রাহিমের মৃত্যু পরিবারে গভীর শোক এবং মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। মা রোকেয়া বেগম স্বাভাবিক হতে পারছেন না, বাবা কবির হোসেন চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। রোকেয়া কণ্ঠে অশ্রু ঝরিয়ে বলেন, “জাবির ছিল আমাদের প্রাণ। সে চলে যাওয়ার পর আমরা কী করে ভালো থাকি?”
শুভর পরিৎপর সংসার
রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ১৯ জুলাই গুলিতে নিহত হন আল আমিন শুভ। নিজের শ্রমে ছোট বোন ও ভাইদের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তিনি। শুভর মৃত্যুর পর ছোট তিন বোন মীম, সুমি ও রুমি বেলুন বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন। মা রেণু বেগম বললেন, “আমার ছেলেকে ফিরিয়ে পেলে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম। আমরা কষ্ট করি, তবুও ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে অসহায়দের জন্য ডাল-চাল দিয়ে শিরনি রান্না করি।”
নারীরাও ছিলেন শহীদ: অসংখ্য অসমাপ্ত গল্প
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন অন্তত ১১ নারী ও শিশু, ১৩২ শিশু-কিশোর আহত হয়েছেন। শহীদদের তালিকায় নাম রয়েছে মায়া ইসলাম, মেহেরুন নেছা, লিজা, রিতা আক্তার, নাফিসা হোসেন মারওয়া, নাছিমা আক্তার, রিয়া গোপ, কোহিনূর বেগম, সুমাইয়া আক্তার, মোসা আক্তার ও নাঈমা সুলতানা সহ আরও অনেকে।
এই নামগুলো শুধু সংখ্যা নয়, বরং প্রতিটি নামের পেছনে লুকিয়ে আছে বেদনাময় কান্না, অসমাপ্ত স্বপ্ন, কাঁদানো ইতিহাস এবং অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প।
এক বছর পার হলেও জুলাই শহীদদের পরিবারগুলো আজও জীবনের আলো থেকে বঞ্চিত। তারা যেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় থেকে বেরোতে পারেনি, ক্ষত এখনও না শুকানো, কান্না থামেনি, আর স্মৃতির জ্বলনে হৃদয় এখনো পুড়ে যাচ্ছে। তাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের জন্য আমাদের দায়িত্ব শুধু স্মরণ রাখা নয়, তাদের সন্তানদের ভালোবাসা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও নিশ্চিত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ