
ছবি: সংগৃহীত
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আয়োজিত শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘিরে ভয়াবহ হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে একজন এনসিপি কর্মী, একজন সাধারণ পথচারী এবং দুইজন স্থানীয় যুবক রয়েছেন। আহত হয়েছেন পুলিশ সদস্য, সাংবাদিকসহ কমপক্ষে আরও ৫০ জন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর পরই গোপালগঞ্জ শহরে জারি করা হয়েছে কঠোর কারফিউ, যা কার্যকর থাকবে বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
বুধবার (১৬ জুলাই) দিনভর গোপালগঞ্জ জেলা শহরে উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন—উদয়ন রোডের বাসিন্দা দীপ্ত সাহা (২৫), কোটালীপাড়ার রমজান কাজী (১৮), টুঙ্গীপাড়ার সোহেল মোল্লা (৪১) ও সদর উপজেলার ভেড়ার বাজার এলাকার ইমন (২৪)।
তাদের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জ্বীবিতেশ বিশ্বাস। তিনি জানান, হাসপাতালে আরও ৯ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং তাদের কয়েকজনের অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় জরুরি অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে বিকেলে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশের সময়, যখন দলটির গাড়িবহর শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে ফিরছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, হঠাৎ করেই একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বহরটির ওপর চড়াও হয়। এ সময় গুলি, ইট-পাটকেল ও বিস্ফোরণের শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।
আহতদের অনেকে জানান, হামলাকারীরা পরিচিত ছিল এবং বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সক্রিয় সদস্য। তারা এনসিপির পতাকা ছিঁড়ে ফেলে এবং দলের নেতাকর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলার সময় একাধিক পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যানবাহনও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্যও আহত হয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
হামলা ও সংঘর্ষের পর গোটা গোপালগঞ্জজুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জনমনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। এই অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক জরুরি বার্তায় ঘোষণা করা হয়, গোপালগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ থাকবে।
জেলা প্রশাসন এক বিবৃতিতে জানায়, "সাম্প্রতিক সময়ের সহিংস অস্থিরতা ও সংঘাতের ঘটনায় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারফিউ চলাকালীন সময় সব ধরনের জনসমাগম, যান চলাচল ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে।" একই সঙ্গে জানানো হয়, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণে মাঠে থাকবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, "এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত এবং হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো হয়েছে। সরকারের প্রশ্রয়ে, নিষিদ্ধ দলীয় বাহিনী গোপালগঞ্জে আমাদের নেতাকর্মীদের রক্তাক্ত করেছে। এই ঘটনা শুধু এনসিপির ওপর হামলা নয়, এটা গণতন্ত্রের ওপর আঘাত।"
তিনি আরও বলেন, “আমরা সারা দেশে গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেটা থামিয়ে দিতে সরকার ও মুজিববাদী বাহিনী জঙ্গি কায়দায় হামলা চালিয়েছে। তবে আমরা ভীত নই, এই লড়াই চলবে।”
গোপালগঞ্জের এই ঘটনার পরপরই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নজর গেছে ওই অঞ্চলের দিকে। কয়েকটি সংস্থা সামাজিক মাধ্যমে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, "একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর এ ধরনের প্রাণঘাতী হামলা গণতান্ত্রিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।"
হামলার জেরে স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। দোকানপাট, অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেছে। শহরজুড়ে থমথমে পরিবেশ, প্রতিটি মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল, নির্বাক জনজীবন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হামলা ও তার জেরে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যার ফলে পরিস্থিতি আরও অস্থির হয়ে উঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা, প্রাণহানি এবং তার প্রেক্ষিতে ঘোষিত কারফিউ—সবকিছু মিলিয়ে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হলো। সরকার ও বিরোধী পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান এক নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জনগণ এখন অপেক্ষায়, এই রক্তাক্ত সংঘর্ষের তদন্ত ও দায়ীদের বিচারের দাবি কতটা বাস্তবায়ন হবে—নাকি এটি আরেকটি অবিচার-অধরার অধ্যায় হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ