
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এখন আর কেবল কাঁটাতারের সীমা নয়, এটি হয়ে উঠেছে হাজার কোটি টাকার চোরাই ব্যবসার করিডোর। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য—প্রতিবছর প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিস, সুতাসহ টেক্সটাইল পণ্য চোরাইপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যা ধ্বংস করে দিচ্ছে দেশের নিজস্ব বস্ত্র শিল্পকে।
প্রতিবেদনটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যাতে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকার একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট, যাদের সঙ্গে কাস্টমস ও শুল্ক কর্মকর্তাদের একটি অংশের আঁতাত রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, নরসিংদীসহ ঢাকার আশপাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী গোডাউন ও রাত্রিকালীন ডেলিভারি নেটওয়ার্ক, যার মাধ্যমে ভারতীয় চোরাই পণ্য রাজধানীর ইসলামপুর, সদরঘাট ও নামীদামি শপিং মলগুলোতে পৌঁছে যায়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতীয় শাড়ি-কাপড় প্রথমে আহমেদাবাদ বা কলকাতা থেকে করিমগঞ্জ ও আগরতলায় পৌঁছে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বেনাপোল, চুয়াডাঙ্গা বা সাতক্ষীরার নির্দিষ্ট পয়েন্টে সীমান্ত পেরিয়ে আসে এসব পণ্য। ট্রাকের পাথরের নিচে চাপা দিয়ে বা নৌপথে ট্রলারে পণ্য আনা হয়। এরপর দেশের অভ্যন্তরে ট্রাকে করে পাঠানো হয় কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। বিক্রির টাকা পাঠানো হয় অবৈধ হুন্ডি চ্যানেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হুন্ডির মাধ্যমেই প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পকে সহায়তার জন্য বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ দেয়। কিন্তু গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, এই বন্ড সুবিধা ভয়ঙ্করভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। আমদানিকৃত পণ্য কখনো ওয়্যারহাউজে পৌঁছায় না, মাঝপথেই তা চলে যায় কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর অস্থায়ী গোডাউনে।
প্রতারণার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে: গার্মেন্টস মালিকরা অতিরিক্ত অপচয় দেখিয়ে বেশি পরিমাণ কাপড় আমদানি করেন, স্যাম্পল পরিবর্তন করে দামি কাপড় আনা হয়, সুতা আমদানিতে কাউন্ট (গ্রেড) জালিয়াতি হয়, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ওজনে কারচুপি করা হয়।
গোপন ডকুমেন্টে ৭টি প্রধান ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছে—বাজারে অস্থিরতা, রাজস্ব ক্ষতি, স্থানীয় শিল্প ধ্বংস, বিনিয়োগ নিরুৎসাহ, শ্রমিক বেকারত্ব, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচার এবং বৈদেশিক মুদ্রা হ্রাস।
গোডাউন থেকে রাত ১২টার পর কাপড় বোঝাই ট্রাক ঢুকে পড়ে ইসলামপুর ও সদরঘাট এলাকায়। গোপন ক্যামেরার ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, হাবিবুল্লাহ মার্কেটসহ একাধিক ভবনে রাতেই কাপড় খালাস হচ্ছে।
বিটিএমএ সহসভাপতি সালেহউদ জামান বলেন, “এই থ্রি-পিসগুলো ভারতীয়—এটা মার্কেটের দোকানিরা নিজেই বলে। অথচ এনবিআর দেখছে না। নরসিংদী, কালিবাড়ি, টানবাজার—সব জায়গায় বিদেশি সুতা বিক্রি হচ্ছে। অথচ কাগজে নেই, শুল্কও নেই।”
তিনি অভিযোগ করে বলেন, “বন্ড কমিশনারেট, শুল্ক গোয়েন্দা, এনবিআর—সব জায়গায় অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেবল চেয়ে চেয়ে দেখছে।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, সীমান্ত হাটের দিনে স্থানীয় মহিলারা দিনে ১৫-২০ বার ভারতে গিয়ে কাপড় ভর্তি ব্যাগ কার্গোতে তোলেন। আইন অনুযায়ী ৫০ থেকে ২০০ ডলারের বেশি মাল আনা নিষেধ হলেও বিজিবি ও বিএসএফকে ম্যানেজ করে বহুগুণ পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়।
একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জানানো হয়, প্রায় সব বড় দোকানের কর্মচারীদের পাসপোর্ট রয়েছে এবং তারা প্রতিমাসে একাধিকবার ভারতে যায়। এসব কর্মচারী কলকাতায় গিয়ে কাপড় সংগ্রহ করে আবার ফিরে আসে, রাত কাটায় রেলস্টেশনে বা সিনেমা হলে।
ব্র্যাকের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহবুব হোসেন বলেন, “চোরাচালানের এই সিন্ডিকেট একদিকে বৈধ ব্যবসাকে ধ্বংস করছে, অন্যদিকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থপাচারকে উসকে দিচ্ছে। বিষয়টি জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি।”
তিনি বলেন, “যেসব ব্যবসায়ী বৈধভাবে শুল্ক-কর দিয়ে পণ্য আনেন, তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন না। এতে বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বেকার হচ্ছে শ্রমিকরা।”
বাংলাদেশের শীর্ষ টেক্সটাইল গবেষক ও আইসিসিবি’র সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সীমান্তে চোরাচালান এক দিনে গড়ে উঠেনি। এর সঙ্গে কাস্টমস, পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের জড়িত থাকার প্রমাণ আছে। তাই এটি থামাতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছতা, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, এবং সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার মতো রাজনৈতিক সদিচ্ছা।”
তিনি আরও বলেন, “বন্ড সুবিধা সীমিত করে দেওয়া হোক প্রকৃত রপ্তানিকারকের মধ্যে। প্রয়োজনে রিয়েল টাইম বন্ড ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার চালু করা হোক, যাতে পণ্যের গতিবিধি ট্র্যাক করা যায়।”
৫৪ হাজার কোটি টাকার চোরাই বস্ত্র বাংলাদেশের রাজস্বকে শুধু গলগ্রাসে গিলে ফেলছে না, বরং একটি সম্ভাবনাময় শিল্প—দেশীয় বস্ত্রশিল্প—কে ধ্বংস করছে প্রতিনিয়ত। আর এই চোরাচালান রোধে গৃহীত পদক্ষেপের অভাব কিংবা প্রশাসনিক অবহেলা যদি চলতে থাকে, তাহলে একদিন হয়তো বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যবাহী কাপড়শিল্প হারিয়ে ফেলবে।
সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখন কোন পথে হাঁটবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
তথ্যসূত্র: গোয়েন্দা প্রতিবেদন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ), এনবিআর, টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞদের মতামত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ