
ছবি: সংগৃহীত
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল চত্বরে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও র্যাব ব্যাপক অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত শুক্রবার কেরানীগঞ্জ থেকে র্যাব-১০ দুই আসামি মনির হোসেন ও আলমগীর হোসেনকে আটক করে। এর আগে ঢাকা পুলিশ মাহমুদুল হাসান মহিন ও তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করেছিল।
নতুন প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজ ও স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ আরও চারজনের পরিচয় শনাক্ত করেছে। তারা হলেন— মিটফোর্ড হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মচারী মো. মনির, অ্যাম্বুলেন্স চালক নান্নু, চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদ্য বহিষ্কৃত সদস্য সচিব অপু দাস ও চকবাজার থানা যুবদলের সাবেক সদস্য সরোয়ার হোসেন টিটু।
ঘটনায় নাম ওঠা পাঁচজনকে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠন—যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল—আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। সংগঠনগুলো এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, সোহাগকে বড় একটি পাথর ও ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। বিশেষ করে মহিনকে সেখানে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে। আশপাশের লোকজন এসব দেখলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। রজনী বোস লেনে সোহাগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সোহানা মেটালের আশপাশে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এই এলাকায় অনেকে চোরাই পণ্য বিক্রি করেন এবং ব্যবসায়ীদের থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেওয়া হয়।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, সোহাগ ও মহিনের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ ও টাকা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ছিল। মহিনের অভিযোগ, সোহাগ তালা ভেঙে দোকান চালু করার পর তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। এরপর মহিন ও সহযোগীরা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যার পর তারা ঘটনাকে গণপিটুনিতে চাঁদাবাজ নিহতের ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করে। তবে পুলিশ এখনো সোহাগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির কোনো প্রমাণ পায়নি।
মহিনের বিরুদ্ধে পুরনো রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। তিনি ছাত্রদল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পরে যুবদলে যোগ দিয়েছিলেন, যদিও কোনো পদে ছিলেন না। তার মা মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্মী। গ্রেপ্তার রবিনের মা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের কর্মী।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র বলছে, সোহাগ মূলত চাঁদাবাজি করতেন, এবং সেই টাকা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে যেত। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এই চাঁদাবাজির দায়িত্ব যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের মাধ্যমে মহিনের দিকে স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছিল। সোহাগ এতে রাজি না হওয়ায় বিরোধ শুরু হয় এবং এর পর হত্যাকাণ্ড ঘটে।
ইসহাক সরকার এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সোহাগের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই এবং মহিন তার কর্মী নয়। তিনি আরও বলেন, সোহাগ কয়েক মাস আগে তাকে টাকা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
স্বজনরা অভিযোগ করেন, সোহাগের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে। তার ভাগনি সাদিয়া আক্তার মীম বলেন, “মামার ব্যবসার অর্ধেক টাকা ও মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইছিল মহিনরা, যা রাজি না হওয়ায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।”
জেলা ও থানার ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল গ্রেপ্তার আসামিদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন জানান, হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মহিন যুবদলের কোনো পদে নেই, তবে পদপ্রত্যাশী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, মহিন ও রবিনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ব্যবসায়িক বিরোধ ও পূর্বশত্রুতার কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে।
সোহাগের পরিবারের অভিযোগ, মামলা থেকে তাদের সম্মতি ছাড়াই তিনজনের নাম বাদ দিয়ে অপর তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, যারা সত্যিই জড়িত তাদেরই মামলায় রাখা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যায় জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি।
সোহাগের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, “আসামিরা ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিতে চেয়েছিল। স্বামী রাজি না হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
বরগুনার বরগুনা সদর উপজেলার বান্দরগাছিয়া গ্রামে সোহাগের জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “অপরাধী যেই হোক, আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গভীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের অভিযুক্তদের আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির অবস্থান জিরো টলারেন্স।”
জামায়াতে ইসলামী হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বলেন, “চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী নেতাদের রাজনীতির মাধ্যমে দেশ কখনোই নিরাপদ হবে না।”
ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ড জাতিকে স্তম্ভিত করেছে। যুবদলের সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিএনপিকে পরিষ্কার করা উচিত।”
গণসংহতি আন্দোলনের নেতারা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দাবিতে বলছেন, “এ ধরনের ঘটনা জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।”
মিটফোর্ড হাসপাতালের শিক্ষার্থী ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বিক্ষোভ মিছিল করে হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার ও এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জানান। তারা হাসপাতালের আবাসিক হল ও আশেপাশের এলাকায় ফুটপাত দখল করে চাঁদাবাজি বন্ধেরও দাবি তুলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।
মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক সংঘাতের প্রেক্ষিতে সংঘটিত এই নৃশংস অপরাধের তদন্ত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার জোরদারকরণের দাবি উঠেছে সর্বত্র।
আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের প্রতি জনগণের নজর এখন বিশেষভাবে কেন্দ্রীভূত। সঠিক তদন্ত ও দ্রুত বিচার না হলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থেকে মুক্তি মিলবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ