
ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম ধর্মে দৈহিক পবিত্রতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং শর্ত। নামাজের মতো ফরজ ইবাদতগুলো আদায়ের আগে শরীরকে পবিত্র রাখা অপরিহার্য। এই পবিত্রতা অর্জনের দুটি প্রধান উপায় হলো ওজু (আবশ্যিক অঙ্গ ধৌত করা) এবং গোসল (সম্পূর্ণ দেহ ধৌত করা)।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন— “হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নামাজে দাঁড়াতে চাও, তখন তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো, তোমাদের মাথায় মাসেহ করো এবং পা টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে ফেলো। যদি তোমরা অপবিত্র থাকো, তবে গোসল করো।” — (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৬)
এই আয়াতের আলোকে অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, যদি কেউ সব শর্ত মেনে গোসল করে নেন, তবে নামাজের আগে তাকে কি আবার নতুন করে ওজু করতে হবে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর—না, নতুন করে ওজু করার প্রয়োজন নেই।
কেন গোসলের পর ওজু জরুরি নয়?
ধর্মীয়ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গোসলের ফরজ তিনটি:
১. কুলি করা,
২. নাকে পানি দেওয়া, এবং
৩. পুরো দেহ ধোয়া।
অন্যদিকে ওজুর ফরজ চারটি:
১. মুখমণ্ডল ধোয়া,
২. দুই হাত কনুইসহ ধোয়া,
৩. মাথায় মাসেহ করা এবং
৪. পা টাখনুসহ ধোয়া।
যদি কেউ সঠিক নিয়মে গোসল করেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ওজুর ফরজ চারটি কাজও তার গোসলের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় ওজুর তুলনায় অধিকতর পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্রতা অর্জিত হয় গোসলের মাধ্যমে।
হাদিস শরিফ থেকেও এই বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আল্লাহর রাসুল (সা.) গোসলের পর নতুন করে ওজু করতেন না।” — (সুনানে নাসায়ি)
আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, “নবীজি (সা.) গোসলের আগে ওজু করতেন, কিন্তু গোসলের পর কখনো নতুন করে ওজু করতে আমি তাকে দেখিনি।” — (তিরমিজি ও নাসায়ি)
এগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, নবীজী (সা.) গোসলের সময়ই ওজুর জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ সম্পন্ন করতেন। ফলে নতুন করে ওজু করতেন না।
অনেকে মনে করেন, গোসলের সময় মাথায় মাসেহ করা হয় না, তাই ওজু সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু ইসলামি পণ্ডিতদের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, গোসলের সময় যখন মাথা ধোয়া হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই মাথায় পানির স্পর্শ পড়ে, যা ‘মাসেহ’-এর প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে ফেলে।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম মুফতি ইউসুফ লুধিয়ানভি (রহ.) বলেন, “মাসেহ মানে হলো ভেজা হাত দিয়ে মাথায় স্পর্শ করা। আর গোসলের সময় তো মাথা পানিতে পুরোপুরি ভিজেই যায়, তাই মাসেহ তো তখন অধিকতরভাবে সম্পন্ন হয়ে যায়।”
প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন মাযহাবের ফকিহরা এই বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের অনেকেই বলেন, গোসলের পর নতুন করে ওজু না করা উত্তম। কারণ এটি ‘পানির অপচয়’ এবং ‘সুন্নাতের খেলাফ’।
ফতোয়ায়ে আলমগিরি নামক বিখ্যাত হানাফি ফিকহগ্রন্থে বলা হয়েছে— “যদি কেউ ফরজ নিয়মে গোসল করে, তবে ওজুর প্রয়োজন পড়ে না। যদি কেউ ওজু করে ফেলে তাও জায়েজ; তবে এটি মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত হবে।” — (ফতোয়ায়ে আলমগিরি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪)
যদি কেউ ইচ্ছা করে নামাজের আগে আবার ওজু করে নেয়, তা হলে সেটি নাজায়েজ বা ভুল নয়। বরং এটি মুস্তাহাব হিসেবে বিবেচিত হবে এবং সে এর জন্য সওয়াবও পাবে। কিন্তু কেউ যদি মনে করে যে, গোসল করলেও ওজু না করলে নামাজ সহি হবে না—তবে সেই ধারণা ভুল এবং ধর্মীয়ভাবে সংশোধনযোগ্য।
তবে মনে রাখতে হবে, গোসলের পর যদি কেউ পেশাব-পায়খানার কাজ সম্পন্ন করেন, হাওয়া ছাড়েন বা ঘুমিয়ে পড়েন—তবে তখন ওজু ভেঙে যাবে। তখন শুধু ওজু করাই যথেষ্ট; গোসলের দরকার নেই।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ও সহজ জীবন ব্যবস্থা। এতে অহেতুক কঠিনতা বা বাড়তি জটিলতা নেই। শরিয়তের বিধান অনুসারে, যদি কেউ গোসলের ফরজ তিনটি ঠিকভাবে আদায় করে নেয়, তবে তার আলাদা করে ওজু করার প্রয়োজন নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমল, সাহাবিদের অভিজ্ঞতা এবং পরবর্তী ফকিহদের মতামত থেকেও এ বিষয়টি সুস্পষ্ট।
তাই মুসল্লিদের উচিত—পবিত্রতা বিষয়ে আত্মবিশ্বাস রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় সন্দেহ বা সংশয়ের মধ্যে না যাওয়া। আর যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওজু করে নেয়, তবে তাতে কোনো অসুবিধা নেই—বরং এটি একটি সওয়াবের কাজ হয়ে যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ