
ছবি: সংগৃহীত
সিলেটে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়া, পরিবহন আইন সংশোধনসহ ছয় দফা দাবিতে ডাকা অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট অবশেষে স্থগিত করা হয়েছে। ধর্মঘটের ফলে সকাল থেকেই পুরো জেলাজুড়ে যান চলাচল অচল হয়ে পড়লেও বিকেলের দিকে প্রশাসনের আশ্বাসে স্থগিতের ঘোষণা আসে।
মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বিকালে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে বসেন। বৈঠকে উত্থাপিত দাবিগুলো 'সুনির্দিষ্টভাবে বিবেচনার প্রতিশ্রুতি' দিলে মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো আপাতত আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয়।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক–শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ধর্মঘট শুরু হয়। এতে সিলেট বিভাগসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস-মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সড়ক মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সুপারিশ এবং সিলেটের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে আমরা আপাতত কর্মসূচি স্থগিত করছি।’
তিনি আরও বলেন, ধর্মঘট সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে আবারও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়, যা সরাসরি সিলেট অঞ্চলের পরিবহন ও পাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লাখো মানুষের জীবিকা ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—
সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৩৬ ধারা অনুসারে বাস-মিনিবাসের জন্য ২০ বছর, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যানের জন্য ১৫ বছর, সিএনজি ও লেগুনার জন্য ১৫ বছর ইকোনোমিক লাইফ নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল।
সিলেটের সব পাথর কোয়ারির ইজারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার এবং সনাতন পদ্ধতিতে বালু ও পাথর উত্তোলন চালু করার অনুমতি।
বিআরটিএ-এর অধীন গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা ছাড়পত্র নেওয়ার প্রক্রিয়া বাতিল।
গণপরিবহনের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত ট্যাক্স প্রত্যাহার।
ক্রাশার মিলগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ বন্ধ, ভাঙচুরের ক্ষতিপূরণ এবং ফেরত দেওয়া বিদ্যুৎ মিটার।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের অপসারণ এবং বালু-পাথর বহনকারী যানবাহনের চালকদের প্রশাসনিক হয়রানি বন্ধ করা।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় পুরো অঞ্চলজুড়ে পাথরভিত্তিক অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পাথর পরিবহন ও ক্রাশিং মিলগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন হাজার হাজার শ্রমিক, চালক, মালীকপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশার মানুষ।
বিশেষ করে ক্রাশার মিলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় অনেক মেশিন অচল হয়ে পড়ে। মালিকদের দাবি, সরকারের নীতিগত জটিলতা ও প্রশাসনিক অতিরিক্ত চাপ এই সংকটের জন্য দায়ী।
আলোচিত দাবির মধ্যে অন্যতম ছিল সিলেটের বর্তমান জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের অপসারণ। মালিক-শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেন, জেলা প্রশাসকের ‘একতরফা ও কঠোর’ ভূমিকার কারণেই পাথর ও বালুবাহী পরিবহনগুলো হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং পাথর উত্তোলনের কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়েছে।
বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী ধর্মঘট আহ্বানকারীদের আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আপনাদের দাবিগুলো বাস্তব এবং আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা যথাযথভাবে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। আলোচনার মাধ্যমেই স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা চলবে।’
তবে ধর্মঘট স্থগিত হলেও প্রশাসনের ভূমিকায় আস্থা রাখতে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। অনেক পরিবহন নেতাই বলছেন, এই আশ্বাস বাস্তবায়িত না হলে দ্রুতই আরও কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে।
সিলেটে পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত হওয়ায় আপাতত যাত্রীদের স্বস্তি ফিরেছে এবং অঞ্চলজুড়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম কিছুটা সচল হয়েছে। তবে পরিবহন খাতের কাঠামোগত সমস্যা, পাথর ব্যবসার প্রশাসনিক সংকট ও সরকারের কিছু নীতিমালার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টদের ক্ষোভ যে ক্রমেই বাড়ছে, তা আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে আগামীতে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ