
ছবি: সংগৃহীত
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কোনো মুহূর্তে রাগের মাথায় উচ্চারিত কিছু শব্দ কখনো কখনো বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বিশেষ করে ইসলামি শরিয়তের আলোকে তালাকের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সচেতনতা না থাকলে ছোট একটি বাক্যই হয়ে উঠতে পারে সম্পর্ক বিচ্ছেদের কারণ। সম্প্রতি এক নারীর প্রশ্ন ঘিরে আলোচনা উঠেছে—স্বামী যদি বলেন “সম্পর্ক শেষ”, তাহলে কি সেটা তালাক হিসেবে গণ্য হবে? ইসলামি আইন অনুযায়ী, বিষয়টি জটিল হলেও এর উত্তর নির্ভর করছে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তের ওপর—স্বামীর নিয়ত।
ঘটনাপ্রবাহ
একজন নারী জানান, একদিন স্বামীর সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। কথার একপর্যায়ে স্বামী বলেন, “তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাইলে আমার কথা মতো চলতে হবে। আর না পারলে আমাকে বলে দিও, আমি তোমার কথা মানতে পারব না। তখন সব শেষ।”
নারীটি জিজ্ঞাসা করলে, “কী শেষ?”—স্বামী জবাব দেন, “সম্পর্ক শেষ।” এরপর আরও বলেন, “তোমার আমার রাস্তা আলাদা।”
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্ত্রীর প্রশ্ন—এই কথার দ্বারা কি তালাক সংঘটিত হয়েছে?
ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি: কী বলে শরিয়ত?
ইসলামি শরিয়তের আলোকে এমন বাক্যকে বলা হয় ‘কেনায়া তালাক’ (كناية طلاق)—অর্থাৎ ইঙ্গিতপূর্ণ বা অস্পষ্ট শব্দ, যা তালাকের সম্ভাব্য অর্থ বহন করে তবে তা সরাসরি তালাক নয়। যেমন—‘সম্পর্ক শেষ’, ‘চলে যাও’, ‘তোমার আমার রাস্তা আলাদা’—এই ধরণের বাক্য হতে পারে তালাকের ইঙ্গিত, কিন্তু তা তালাক বলে গণ্য হবে কি না, তা নির্ভর করে স্বামীর নিয়ত বা অভিপ্রায়-এর ওপর।
‘সম্পর্ক শেষ’ মানেই তালাক নয়—নিয়তই মূল বিষয়
ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া (১/৩৭৫)-এ বলা হয়েছে, “কেনায়া তালাক তখনই কার্যকর হবে যখন তালাক দেওয়ার নিয়ত থাকবে।”
অর্থাৎ যদি স্বামী ‘সম্পর্ক শেষ’ বলার সময় তালাক দেওয়ার ইচ্ছা রাখেন, তাহলে সেটি এক তালাকে বাইন হিসেবে গণ্য হবে। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক তাৎক্ষণিকভাবে শেষ হয়ে যাবে এবং পুনরায় একসাথে থাকতে চাইলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
আর যদি ওই সময় স্বামী তালাক দেওয়ার ইচ্ছা না রাখেন, বরং কেবল ঝগড়ার রেশে এমন কথা বলেন, তাহলে সেটা শরিয়ত অনুযায়ী তালাক বলে বিবেচিত হবে না।
তালাকের প্রকারভেদ ও ফেরত পাওয়ার বিধান
ইসলামি আইনে তালাক তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে:
১. তালাকে রাজঈ (رجعي طلاق) – প্রথম বা দ্বিতীয় তালাক হলে, স্ত্রী ইদ্দত (তিন হায়েজ বা তিন মাস) শেষ হওয়ার আগেই মৌখিক বা কার্যতভাবে (সহবাসের মাধ্যমে) ফেরত নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতির প্রয়োজন নেই।
২. তালাকে বাইন (بائن طلاق) – এমন তালাক যাতে সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যেমন—কেনায়া তালাক নিয়তের সাথে দিলে। এতে রুজু করা যায় না, বরং নতুন মোহর নির্ধারণ করে পুনরায় বিয়ে করতে হয়।
৩. তালাকে মুগাল্লাযা (তিন তালাক) – একসঙ্গে তিন তালাক দিলে তা চূড়ান্ত বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পুনর্মিলনের জন্য তখন স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বৈধ বিয়ে ও সংসার করতে হবে এবং পরে সে যদি তালাক দেয় বা মারা যায়, তবে ইদ্দত শেষে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে করা যাবে। এটিকে বলা হয় ‘হিল্লা শরয়ি’।
ইদ্দতের বিধান
তালাকের পর স্ত্রীকে অবশ্যই ইদ্দত পালন করতে হয়।
হায়েজ আসা নারীদের জন্য ইদ্দত: তিন হায়েজ।
হায়েজ না আসা নারীদের জন্য: তিন মাস।
গর্ভবতী হলে: সন্তান প্রসব পর্যন্ত।
‘সম্পর্ক শেষ’ বলার কারণে তালাক হবে কি না, তা একমাত্র স্বামীর নিয়তের ওপর নির্ভর করে। এই বাক্য তালাক নির্দেশ করে এমন সম্ভাবনা থাকলেও, যদি তালাকের নিয়ত না থাকে, তাহলে তা বৈধ তালাক বলে গণ্য হবে না। তবে তালাকের নিয়ত থাকলে, তা হবে এক তালাকে বাইন এবং পুনরায় একসঙ্গে থাকতে চাইলে শরিয়তসম্মতভাবে নতুন করে বিবাহ বন্ধন করতে হবে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া, ধৈর্য ও ইসলামি আইন জানা জরুরি। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কোনো শব্দ উচ্চারণ করার আগে জেনে-বুঝে কথা বলাই শ্রেয়, কারণ একটি কথাই হতে পারে সম্পর্কের শেষ বা নতুন করে শুরু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ