
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। আগে যেখানে প্রায় ১৫ শতাংশ শুল্ক থাকত, সেখানে তা প্রায় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত হলো তৈরি পোশাক, যা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশ জোগায় এবং যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম প্রধান বাজার। এই অবস্থায় মার্কিন শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিতে কীভাবে পড়বে, তা নিয়েই ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, “আমরা এই শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কাছে গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখতে বলেছি। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা রয়েছে, তার ভিত্তিতে আমরা বুঝতে পারবো এর পরিণতি কী হতে পারে।” তিনি সরকারের দ্রুত ও সুচিন্তিত পদক্ষেপের ওপর জোর দেন।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, “শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি প্রথম শুনেই আমরা সরকারের কাছে দ্রুত সমাধানের জন্য অনুরোধ করেছি। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরাসরি সম্পৃক্ততার দাবি জানিয়েছি। আজ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করার সময় চাইছি, যেখানে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য লবিস্ট নিয়োগের প্রস্তাব দেব।”
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে এহসান শামীম বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য কোনো জরুরি সংকটের কথা বলার সময় নয়। তবে বিষয়টি তিনটি প্রধান সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে—যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর কী শুল্ক আরোপ করে, ভারতের সঙ্গে কী ধরনের বাণিজ্যিক চুক্তি হয় এবং ব্রিকসের অন্য দেশগুলোর ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয় কি না।”
তিনি আরও বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে এবং ভারতের জন্য ছাড় দেয়, তাহলে বাংলাদেশের জন্য তা ভালো। কারণ, এতে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি বেড়ে যেতে পারে, কিন্তু ভিয়েতনামের পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা সীমিত, তাই বাংলাদেশকে সুযোগ আসতে পারে। অন্যদিকে, ব্রিকসের দেশগুলোতে যদি অতিরিক্ত শুল্ক হয়, তবে বাংলাদেশ এই বাজারের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে।”
অর্থনীতিবিদ ড. সৈয়দ আলমগীর বলেন, “শুল্ক বৃদ্ধি কোনোভাবেই বাংলাদেশের রপ্তানির জন্য ইতিবাচক নয়। তবে সঠিক কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশল গ্রহণ করলে এটি মোকাবেলা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি ও লবিস্ট নিয়োগ জরুরি। সরকারের উচিত দ্রুত একটি জাতীয় কৌশল প্রণয়ন করে এ বিষয়ে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো।”
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. মাহবুবউল্লাহ বলেন, “এই পরিস্থিতিতে আমাদের শুল্ক বাড়ানোর প্রভাব কমাতে হলে প্রাথমিকভাবে বাজার বৈচিত্র্য আনতে হবে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকোর মতো দেশগুলো থেকে আমদানি কমিয়ে বাংলাদেশে উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি উচ্চমানের পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে হবে।”
একই সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না থেকে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কৌশল গ্রহণ করতে হবে। লবিস্ট নিয়োগ ও মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।
সরকারও ইতোমধ্যেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করতে এবং শুল্ক বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব কমানোর জন্য লবিস্ট নিয়োগ সহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
সার্বিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের জন্য দরকার কৌশলগত দরকষাকষি, আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও বাজার বৈচিত্র্যের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা অর্জন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার ও বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ