
ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বহুল আলোচিতভাবে চাকরি হারানো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে তার পূর্বের পদে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শরীফ উদ্দিনের বরখাস্তকে ঘিরে যে বিতর্ক, জনআলোচনা ও প্রতিবাদ দেখা গিয়েছিল, তা নতুন মোড় নেয় এই রায়ে। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, তার বরখাস্তের সিদ্ধান্ত আইন ও ন্যায়ের পরিপন্থী ছিল।
বুধবার (৯ জুলাই) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, শরীফ উদ্দিনকে ৩০ দিনের মধ্যে তার পূর্বের পদে পুনর্বহাল করতে হবে। পাশাপাশি, তার যাবতীয় পাওনা ও সুযোগ-সুবিধাও ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “একজন সৎ, নির্ভীক ও কর্মনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে কোনো ধরনের বিভাগীয় শুনানি ছাড়া এভাবে বরখাস্ত করা সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ন্যায়বিচারের স্বার্থেই তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা জরুরি।”
দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকালে শরীফ উদ্দিন কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ভূমি অধিগ্রহণ, অবৈধ সম্পদ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান পরিচালনা করেছিলেন। তার তদন্তে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী চাপে পড়ে। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নানা চাপ ও হুমকি সত্ত্বেও রিপোর্ট ও তদন্তে আপস করেননি। ফলে তাকে ঘিরে রীতিমতো জনপ্রিয়তা তৈরি হয়, যা বাংলাদেশে দুর্লভ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছিল, ‘প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাওয়ায় তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো’। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পেশাজীবী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ একে ‘সততার শাস্তি’ বলে অভিহিত করে। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না, এবং তিনি বরং দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
বরখাস্তের পর শরীফ উদ্দিন হাইকোর্টে রিট করেন। তার রিট আবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ২৭, ২৯ ও ৩১ অনুচ্ছেদের আলোকে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া অন্যায্য এবং তা আইনের পরিপন্থী। তিনি কোনো নিয়ম বা আইন লঙ্ঘন করেননি, বরং দায়িত্বশীলভাবে তদন্ত পরিচালনা করেছিলেন।
হাইকোর্টে রিটের শুনানিতে দুদকের আইনজীবী দাবি করেন, কমিশনের নিজস্ব প্রশাসনিক এখতিয়ার বলে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে আদালত সেই যুক্তিকে খণ্ডন করে বলে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তিকে এভাবে ‘কারণবিহীনভাবে’ বরখাস্ত করতে পারে না। বিশেষ করে, যিনি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাকে এভাবে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সরকারের ভাবমূর্তির জন্যও নেতিবাচক।
রায়ের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শরীফ উদ্দিনের সমর্থনে আবারও ব্যাপক আলোড়ন দেখা দেয়। অনেকেই লিখেছেন, “এটি ন্যায়ের জয়, এবং একজন সৎ কর্মকর্তার জন্য প্রাপ্য সম্মানের পুনঃস্থাপন।” দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন হাইকোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।
বামধারার রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন, সরকারের উচিত ছিল শরীফ উদ্দিনের মতো একজন কর্মকর্তাকে উৎসাহ দেওয়া, তার কর্মনিষ্ঠাকে পুরস্কৃত করা। বরং তাকে বরখাস্ত করে একটি ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল। এ রায়ের মাধ্যমে সে অন্যায় কিছুটা হলেও শোধরানোর সুযোগ তৈরি হলো।
প্রশাসনিক বিশ্লেষক ও আইনবিদরা বলছেন, এ রায় শুধু একজন ব্যক্তির চাকরি ফেরতের নির্দেশ নয়; এটি সরকারি প্রশাসনে ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নে একটি মাইলফলক। বাংলাদেশে যেখানে নৈতিকতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে কর্মকর্তারা নানা চাপের মুখে পড়েন, সেখানে হাইকোর্টের এ ধরনের রায় ভবিষ্যতের জন্য এক সাহসিকতা ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
দুদক হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে কি না, সে বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানায়নি। তবে সংস্থার অভ্যন্তরে এ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। meanwhile, শরীফ উদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি দেশ ও জনগণের কল্যাণে আবারও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত।
এই রায় বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং ন্যায়ের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শরীফ উদ্দিনের পুনর্বহাল কেবল একটি চাকরি ফিরে পাওয়ার ঘটনা নয়, বরং একটি সামাজিক ন্যায়ের পুনরুদ্ধার বলেও দেখছেন অনেকেই।
বাংলাবার্তা/এসজে