
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলাকালে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান চলাকালে দেশজুড়ে চলমান গণবিক্ষোভ দমন অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীকে সরাসরি ‘মারণাস্ত্র ব্যবহারের’ নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি—এমন একটি ফাঁস হওয়া ফোনকলের অডিওর সত্যতা সম্প্রতি যাচাই করে নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী মাধ্যম বিবিসি আই (BBC Eye)।
এই ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে স্পষ্টভাবে বলতে শোনা যায়, “যেখানেই আন্দোলনকারী পাওয়া যাবে, গুলি করা হবে।” এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, বিক্ষোভ দমনে শান্তিপূর্ণ ও সহনশীল পন্থার পরিবর্তে সরাসরি প্রাণঘাতী সহিংসতা চালাতে সরকার প্রধান নিজেই নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়া ৭ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ডে একজন নারীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কণ্ঠে বলতে শোনা যায়— “আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি, কোথাও যদি দেখি জমায়েত হচ্ছে, সরাসরি গুলি করবা। কোনো জলকামান-পুলিশি কায়দা লাগবে না। যারা আন্দোলন করছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে উদাহরণ তৈরি করে।”
বিবিসি আই-এর ফরেনসিক অডিও বিশ্লেষক দল দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত করেছে যে, কণ্ঠস্বরটি শেখ হাসিনারই এবং রেকর্ডটি জেনুইন।
এই অডিও ক্লিপটিকে বর্তমানে বিচারাধীন আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রসিকিউশন। বিচারটি শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই পরিচালিত হচ্ছে। তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে গণহত্যা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও যুদ্ধাপরাধের শামিল অপরাধে।
বিশেষ করে এই অডিও প্রমাণটি, প্রসিকিউটরদের মতে, ‘সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে হত্যার নির্দেশ’ প্রমাণ করতে সহায়তা করবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০২৫ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের অভ্যুত্থানবিরোধী গণআন্দোলনের সময় কমপক্ষে ১,৪০০ বিক্ষোভকারী নিহত হন, যাদের অনেকে ছিলেন অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র। হাজার হাজার মানুষকে গুম, আটক বা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়। গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, অধিকাংশ প্রাণহানি ঘটেছে রাজধানী ঢাকাসহ সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে।
এই অডিও ফাঁস ও বিবিসি আই-এর যাচাইয়ের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনাকে “রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নির্দেশ” হিসেবে অভিহিত করেছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসেও এ নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, যেখানে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সুপারিশ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার দল কিংবা ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মহল থেকে এই ফোনকলের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ফাঁস হওয়া তথ্যকে “ষড়যন্ত্র ও মনগড়া” হিসেবে আগেও অভিহিত করা হয়েছিল। তবে এবার অডিওর ফরেনসিক বিশ্লেষণ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া যাচাইয়ের পর সরকারের অবস্থান চাপের মুখে পড়তে পারে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ফোনালাপ এক ঐতিহাসিক নজির তৈরি করতে যাচ্ছে, যেখানে একটি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যার আদেশ দেওয়ার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার চলছে এবং তা বৈধ প্রমাণের দিকে এগোচ্ছে। যদি প্রসিকিউশন এই অডিও প্রমাণের ভিত্তিতে হাসিনার বিরুদ্ধে রায় আদায় করতে সক্ষম হয়, তবে সেটি হবে গণতন্ত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি বড় উদাহরণ।
ফাঁস হওয়া অডিওর সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আরও দৃঢ় হয়েছে। তার সরাসরি নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে হাজারো প্রাণ ঝরে গেছে—এই অভিযোগের প্রমাণ এখন কেবল রাজনৈতিক নয়, আন্তর্জাতিক বিচারিক নথিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে তার অবস্থান নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এখন দেখার বিষয়, এই বিচার প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ