
ছবি: সংগৃহীত
মালয়েশিয়ায় ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগে আটক হয়ে দেশে ফেরত আসা চার বাংলাদেশিকে ঢাকায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান এই চারজনের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই সঙ্গে আদালত তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
পুলিশের দাবি, এই চারজন মালয়েশিয়ায় থেকে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দেশের বাইরে থেকে অনলাইনের মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ও চাঁদা আদায়সহ নানা তৎপরতা চালাতেন তারা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে ফিরে এসে এদের কেউ কেউ দেশেও ‘উগ্রবাদী তৎপরতা’ চালাতে পারেন বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে।
মঙ্গলবার কারাগার থেকে চারজনকে আদালতে হাজির করা হলে, পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক কে এম তারিকুল ইসলাম তাঁদের ‘বিমানবন্দর থানায় দায়েরকৃত সন্ত্রাসবিরোধী মামলায়’ গ্রেফতার দেখিয়ে প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আজিজুল হক দিদার রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এমদাদুল হক বিজয় রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
উভয় পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক বলেন, “মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অংশীদারের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনায় নিয়ে, অভিযোগের যথাযথ তদন্তের স্বার্থে রিমান্ড মঞ্জুর করা প্রয়োজন।” আদালত এরপর প্রত্যেক আসামির চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডে যাওয়া চার ব্যক্তি হলেন— নজরুল ইসলাম সোহাগ, মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, জাহেদ আহমেদ ও মাহফুজ।
এরা সবাই গত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার হয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এরপর এন্টি টেররিজম ইউনিট তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে।
পুলিশ জানায়, ৫ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা ‘আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের’ মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিলেন। তারা অনলাইনে বাংলাদেশিদের ধর্মীয় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে সদস্য সংগ্রহ, চাঁদা আদায় ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন।
তাদের তহবিল সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়েও বিস্তারিত বিবরণ এসেছে অভিযোগে। অভিযোগে বলা হয়, তারা বছরে ৫০০ রিঙ্গিত করে চাঁদা দিতেন সংগঠনে। এই অর্থ সংগৃহীত হতো ‘স্বেচ্ছা অনুদানের’ মাধ্যমে, যা পরে আন্তর্জাতিক ই-ওয়ালেট ও মানি ট্রান্সফার সার্ভিসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি সাইফুদ্দিন নাসুতিওন ইসমাইল গত ২৭ জুন গণমাধ্যমে জানান, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৩৬ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৫ জনকে মালয়েশিয়ার দণ্ডবিধির ৬এ ধারা অনুযায়ী সন্ত্রাসবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সেলাঙ্গর ও জোহর রাজ্যে তিন দফায় ২৪ এপ্রিল থেকে ২১ জুন পর্যন্ত ওই অভিযান চালায় দেশটির পুলিশ। এই অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে শক্ত অভিযোগ রয়েছে, তাদেরই পর্যায়ক্রমে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে ফেরত আসা ব্যক্তিদের বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর উদ্বেগ প্রবল। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এদের অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে উগ্রবাদী তৎপরতায় জড়াতে পারে। অভিযোগে বলা হয়, এই ব্যক্তিরা দেশের সংহতি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে এবং যে কোনো সময় তারা বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ঘটাতে পারে।
তালিকায় থাকা ৩৫ জন আসামির মধ্যে আছেন: পারভেজ মাহমুদ পাবেল, শরীফ উদ্দিন, রহমান মোহাম্মদ হাবিবুর, সালেহ আহমেদ, মো. আব্দুস সহিদ মিয়া, মো. মতিন, ফয়সাল আলম, রায়হান আহমেদ, মো. রাজ, মো. মনসুরুল হক, ইমন মহিদুজ্জামান, আকরাম মো. ওয়াসিম, শেখ সালাম, মো. রাজ মাহমুদ মন্ডল, আশরাফুল ইসলাম, মো. ফয়সাল উদ্দিন, রবিউল হাসান, মো. সোহেল রানা, মো. আফসার ভূঁইয়া, হোসাইন সাহেদ, মো. আশিকুর বিশ্বাস, মো. শাওন শেখ, ইয়াসিন আলী, মো. পারভেজ মোশারফ, মহিউদ্দিন, সাব্বির হোসাইন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শাকিল মিয়া, আসাদুজ্জামান হোসাইন এবং মো. সোহাগ রানা।
তাদের মধ্যে আরও অনেকেই মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরত আসছেন অথবা ফেরত আনার প্রক্রিয়ায় আছেন।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা সবাই জঙ্গি নন। তিনি বলেন, “সবার বিরুদ্ধে সমান অভিযোগ নেই। মালয়েশিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী যাদের সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে, তাদেরই প্রাথমিকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এই গ্রেফতার এবং বিচারিক কার্যক্রম বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিষয়টির কূটনৈতিক ও আইনগত দিক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার হওয়া ও পরে দেশে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী মামলার তদন্ত এখন নতুন মোড় নিচ্ছে। চারজনের রিমান্ড মঞ্জুরের মাধ্যমে তদন্ত আরও গভীরে প্রবেশ করছে। তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হলে এটি কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও বৈদেশিক সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কূটনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ—একদিকে অপরাধীদের শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা, অন্যদিকে নিরপরাধ প্রবাসীদের রক্ষা করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ