
ফাইল ছবি
বর্ষার শুরু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা শহর যেন সাঁতরে ওঠে। পানির তলিয়ে যাওয়া রাস্তা আর জলাবদ্ধতায় দিন-রাত দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। প্রতি বছর এ দুর্ভোগের বিরুদ্ধে নানা প্রকল্প নেওয়া হয়, বিপুল বাজেট বরাদ্দ করা হয়, কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন চোখে পড়ে না। জলাবদ্ধতার পুরনো সমস্যা থেকে শুরু করে নতুন চ্যালেঞ্জও যোগ হয়েছে, যার কারণে ঢাকা শহরের বর্ষা মৌসুমটা এখন এক বিপজ্জনক নগর-দুর্যোগে পরিণত হচ্ছে। বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাল-জলাশয়ের দখল ও দুর্বল পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঢাকার এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
প্রতিটি বর্ষায় একই চিত্র, কিন্তু সমাধান মেলেনি
ঢাকার বেশ কিছু এলাকা বর্ষাকালে নিয়মিত জলাবদ্ধতায় ভুগছে। পুরান ঢাকার বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ বলেন, "ছোটবেলায় আমরা কখনো এমন জলাবদ্ধতা দেখিনি, এখন অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা হাঁটু-কমরো পানিতে তলিয়ে যায়। প্রতি বছর চিহ্নিত এসব স্পটে জলাবদ্ধতা হলেও সিটি কর্পোরেশন সঠিক কোনো সমাধান নেয়নি।"
নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী খাদেমুল ইসলাম জানিয়েছেন, "প্রতি বছর বর্ষার সময় আতঙ্কে থাকি। দোকানে পানি উঠলে লাখ লাখ টাকার মাল ক্ষতি হয়। কাজ চলছে বলে সিটি কর্পোরেশন বলে, কিন্তু বাস্তবে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না।" আর বাইক রাইডার খলিলুর রহমান বলেন, "বৃষ্টির দিনে রাইড চালানো জীবনের ঝুঁকি। পানির নিচে অনেক ম্যানহোল খোলা থাকে। প্রতি বছর একই ছবি, এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।"
বরাদ্দ আছে, কাজ কি যথাযথ?
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) জলাবদ্ধতা নিরসনে ৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর বাইরে খাল ও জলাশয় পরিষ্কারে ৩০ কোটি, পাম্প স্থাপনে ১ কোটি টাকার মতো বাজেট ঘোষিত হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) বরাদ্দ রেখেছে পাম্প হাউজ আধুনিকায়নে ২৫ কোটি টাকা, খাল উন্নয়ন ও বৃক্ষরোপণে ৩৮ কোটি, নর্দমা পরিষ্কারে ১১ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি খাল-কালভার্ট রক্ষণাবেক্ষণে ১০ কোটি, পাম্প হাউজ রক্ষণাবেক্ষণে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
এসব বাজেট সত্ত্বেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে। অনেকগুলো ড্রেন ও খাল ভরাট, দখল বা অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হওয়ায় পানির সঠিক নিস্কাশন হচ্ছে না।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ: দখল, অবৈধ ভরাট ও দুর্বল অবকাঠামো
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকার চারপাশে থাকা নদী ও অসংখ্য খাল একসময় প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করত। কিন্তু এখন প্রায় অর্ধেক খাল অবৈধ দখলে চলে গেছে। এই অবৈধ দখল ও খাল ভরাট জল নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।
জলাবদ্ধতা কমানোর জন্য অন্তত ১৫টি দখল হওয়া খাল পুনরুদ্ধার করতে হবে, যা ঢাকার জলাবদ্ধতার ৮০ শতাংশ নিরসনে সাহায্য করবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, “আমরা বেশ কিছু জলাবদ্ধ এলাকা চিহ্নিত করেছি। পানির নিষ্কাশনের পকেটগুলো পরিষ্কার করছি। পরবর্তী বছরে আমরা দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরি করব, যা এক থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে পানি কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।”
ড্রেনেজ ব্যবস্থা: হস্তান্তর হলেও কার্যকারিতা নেই
ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা হস্তান্তর করার পরেও পরিস্থিতির কোনও বড় উন্নতি হয়নি। ড্রেনের ঢাল কম, অনেক জায়গায় ড্রেনের মুখ বর্জ্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে বৃষ্টির পানি বের হতে পারছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অপরিহার্য। এসব পরিকল্পনা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে এই কাজের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। অন্যদের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সব সংস্থার সমন্বয়ই ঢাকাকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে পারবে।”
নগরের ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়েছে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা
একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য জলাশয় ও সবুজ ভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ৩৫-৪০ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকা শহরের জলাশয় মাত্র ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, আর সবুজ ভূমি মাত্র ৭ শতাংশের নিচে। ৮০ শতাংশ এলাকা এখন কংক্রিটে আবৃত।
এরফলে বৃষ্টির পানি মাটিতে না প্রবেশ করে রাস্তা ও বাড়ি-ঘরে জমে থাকে, যা জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ।
বরাবরের মতো বর্ষার আগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জলাভূমি যেমন বারিধারা, আফতাবনগর, বাড্ডা, মেরাদিয়া, বাউনিয়া ইত্যাদি অবৈধভাবে ভরাট হওয়ায় জলাবদ্ধতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
পলিথিন ও কঠিন বর্জ্য ঢাল, খাল ও নর্দমায় জমে পানির সঠিক চলাচল ব্যাহত করছে। দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এই সমস্যা আরও বাড়াচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের করণীয় পরামর্শ
জলাবদ্ধতা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে খাল পুনরুদ্ধার জরুরি। ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান অনুসরণ করে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্য নিক্ষেপ নিষিদ্ধ করতে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। নিয়মিত খাল, ড্রেন পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যমান জলাধার সংরক্ষণ ও নতুন জলাধার সৃষ্টি করতে হবে যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে।
ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ জানান, “আমরা অবৈধ দখল উচ্ছেদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতে কার্যকর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে কাজ করছি।”
নাগরিকদের ভোগান্তি ও প্রতিক্রিয়া
জলাবদ্ধতা নগরবাসীর জীবনে বিশাল অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিরপুর, কাজীপাড়া, কালশী, পল্লবী, নবাবগঞ্জ, ধানমন্ডি, নীলক্ষেত, মগবাজার, বনানী, উত্তরা, কারওয়ান বাজারসহ প্রায় ঢাকার সব প্রান্তে বর্ষাকালে পানি জমে যান চলাচল ও দৈনন্দিন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ বলেন, “জলাবদ্ধতার কারণে রিকশা চলাচল বন্ধ, হাঁটাও কঠিন হয়।”
ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা বলেন, “বৃষ্টির দিন অফিসে যেতে হাঁটু পানির মধ্যে দিয়ে যাওয়া লাগে। কেউ বুঝে না আমাদের কষ্ট।”
সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া মুক্তি মুশকিল
ঢাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা কোনো একক সংস্থার কাজ নয়, এটি সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সমাধান করা সম্ভব।
অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না থাকলে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন অসম্ভব।”
পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরাও বলছেন, “অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা, খাল ও জলাশয় রক্ষা করা, ড্রেনেজ সিস্টেম আধুনিকায়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।”
ঢাকার জলাবদ্ধতা শুধু একটি মৌসুমিক সমস্যা নয়, এটি ক্রমবর্ধমান নগর-দুর্যোগ। প্রতিবার বর্ষা এলেই লাখ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যানজট ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় ব্যাপক।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলদারিত্ব, দুর্বল অবকাঠামো, অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা এই দুর্ভোগের মূল কারণ। দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া আগামী বর্ষায় একই ছবি পরিলক্ষিত হবে, যা নগরবাসীর জন্য ভয়ঙ্কর সংকেত।
ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এখন সময় এসেছে সম্মিলিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, নইলে শহর ডুবে থাকবে দুর্ভোগের পানিতে।
বাংলাবার্তা/এসজে