
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনায় ছিল। রোববার (৬ জুলাই) এই দীর্ঘসময়কালীন চুক্তি শেষ হওয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে এনসিটির দায়িত্ব হস্তান্তর করা হলো বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডের হাতে। আজ সোমবার থেকে ড্রাইডক টার্মিনাল পরিচালনায় আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করবে।
সাইফ পাওয়ারটেক ২০০৭ সাল থেকে এনসিটির কার্যক্রম নির্বাহ করে আসছিলো। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমীন জানান, নৌবাহিনীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তবে তারা চুক্তি অনুযায়ী চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) তে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।
আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে সরাসরি নৌবাহিনীকে দায়িত্ব না দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান ড্রাইডকের সঙ্গে ছয় মাসের জন্য এনসিটি পরিচালনার চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “টেকনিক্যাল কারণে সরাসরি নৌবাহিনী টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেনি, তাই ড্রাইডকের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকার থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর বিষয়টি বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় অনুমোদিত হয়েছে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব
চট্টগ্রাম বন্দরে চারটি প্রধান কনটেইনার টার্মিনাল রয়েছে — চট্টগ্রাম কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (কনটেইনার ও বাল্ক-জিসিবি) এবং পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। চলতি অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালে মোট ৩২ লাখ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মধ্যে ৪৪ শতাংশ এনসিটি এককভাবে পরিচালনা করেছে, যা বন্দর ব্যবস্থাপনায় এর গুরুত্ব সুস্পষ্ট করে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বন্দর ও সামুদ্রিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আশরাফ আলী বলেন, “সাইফ পাওয়ারটেকের দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে এনসিটি পরিচালনার অভিজ্ঞতা অমূল্য। তবে নতুন দায়িত্ব নেওয়া নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন ড্রাইডক কর্তৃপক্ষের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা এবং আধুনিকায়ন। সামরিক সংস্থার পরিচালনায় বন্দর ব্যবস্থাপনায় পারদর্শিতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং গুণগতমান বজায় রাখা নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে বন্দর পরিচালনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আসতে পারে যা প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক শামীমা হোসেন বলেন, “বন্দর পরিচালনায় সামরিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি নিরাপত্তা বৃদ্ধি করলেও বাণিজ্যিক দক্ষতা বজায় রাখাটাও জরুরি। ড্রাইডকের মতো সংস্থার এই দায়িত্ব গ্রহণ দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত, যদি তারা সেবার গুণগত মান ও দ্রুততা বজায় রাখে। তবে এই পরিবর্তনের ফলে খরচ বৃদ্ধি বা নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে কি না, তাও পর্যবেক্ষণ করা উচিত।”
বন্দর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সাইফ পাওয়ারটেক দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে, তাদের বিদায়ের ফলে শ্রমিকদের জন্য কিছু অনিশ্চয়তা আছে। নৌবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ড্রাইডকের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি যাতে শ্রমিকদের অধিকার ও সুবিধা নিশ্চিত থাকে। আশা করি নতুন কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সাথে খোলাখুলিভাবে কাজ করবে।”
পরিবহন ও লজিস্টিকস উদ্যোক্তা লায়লা আক্তার বলেন, “নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি-আমদানি কেন্দ্র। এর সুষ্ঠু ও আধুনিক পরিচালনা ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ড্রাইডকের মাধ্যমে পরিচালনা শুরু হওয়ায় যদি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং দ্রুত সেবা নিশ্চিত হয়, তবে ব্যবসায়িক পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।”
পরবর্তী প্রক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ
বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ড্রাইডকের এই নতুন ছয় মাসের চুক্তি হবে একটি পরীক্ষামূলক সময়, যার মধ্যে উন্নত মানের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বন্দর কর্মচারী ও শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও কল্যাণের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
নৌবাহিনী ও ড্রাইডকের দায়িত্বশীলরা জানিয়ে দিয়েছেন, তারা বন্দর ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং সামরিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা করছেন। তবে বাণিজ্যিক স্বার্থ ও জনসাধারণের সুবিধা বিবেচনায় নিয়েই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সার্বিকভাবে, সাইফ পাওয়ারটেকের বিদায়ের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে নতুন অধ্যায় শুরু হলো। নতুন পরিচালন ব্যবস্থায় বন্দর কার্যক্রম কতটা সুচারুভাবে পরিচালিত হয় এবং দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যে কী পরিবর্তন আসে, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তনের সুফল পেতে হলে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও আধুনিকায়নে আরও মনোযোগ দিতে হবে।
প্রসঙ্গ, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৩২ লাখ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মধ্যে ৪৪ শতাংশেরও বেশি এনসিটি পরিচালিত হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে এই টার্মিনালের গুরুত্বকে বিশেষ করে তুলে ধরে।
বাংলাবার্তা/এসজে