
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা যেন প্রতিদিনই নতুন করে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর চালানো অব্যাহত বিমান ও স্থল হামলায় আরও ৮২ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে কেবল গাজা সিটির বিভিন্ন এলাকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৩৯ জন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু বসতবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ও ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র। হতাহতদের মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক।
গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, চলমান সহিংসতায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। এদিকে, মার্কিন প্রশাসনের মধ্যস্থতায় সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন চিত্র—কথিত ত্রাণ সহায়তার আড়ালেও বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে আল জাজিরা জানায়, শনিবার পর্যন্ত ইসরাইলি বাহিনীর তাণ্ডবে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র থেকে খাবার সংগ্রহ করতে এসে হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৭৪৩ জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৪ হাজার ৮৯১ জন। অধিকাংশ হামলা চালানো হয়েছে এমন সময়, যখন হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মার্কিন প্রশাসন দাবি করছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত জিএইচএফ গাজার মধ্যে একমাত্র ত্রাণ সরবরাহকারী সংগঠন, যারা কার্যকরভাবে খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে। যদিও বাস্তবচিত্র বলছে, ইসরাইলি বাহিনী ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর আশপাশেও হামলা চালাচ্ছে, যার শিকার হচ্ছে অসহায় মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় নিরাপদ কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট নেই বলেই অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা।
গত জুনের শেষ সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, জিএইচএফকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়া হবে গাজায় মানবিক সহায়তার জন্য। কিন্তু সেই অনুদান কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা—এ নিয়ে উঠেছে তীব্র প্রশ্ন। সমালোচকেরা বলছেন, এই অর্থ বরং সংঘাতকেই দীর্ঘস্থায়ী করছে, কারণ ইসরাইলি বাহিনী এসব কেন্দ্রের নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো সেগুলোকেই টার্গেট বানাচ্ছে।
বিষয়টিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও কিছু রাষ্ট্র। কিন্তু ওয়াশিংটনের তরফে এখনো ইসরাইলকে সামরিক তৎপরতা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়নি।
চলমান রক্তক্ষয় থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছেন। শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, তিনি ৬০ দিনের একটি যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা দিয়েছেন এবং ইতোমধ্যে ওই প্রস্তাব হামাসের পক্ষ থেকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আগামী সপ্তাহেই গাজায় একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতে পারে।”
এদিকে, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনার জন্য মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকরা মনে করছেন, এটি গাজায় কয়েক মাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে বাস্তবসম্ভব ইঙ্গিত।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক আক্রমণে ইসরাইলে প্রাণ হারায় অন্তত ১,২০০ জন এবং প্রায় ২৫১ জন ইসরাইলিকে জিম্মি করে নেওয়া হয়। এরপর থেকে চলমান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা আজও থামেনি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, এ পর্যন্ত প্রায় ৩৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও কয়েক লাখ। ধ্বংস হয়ে গেছে শহরের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভবন ও অবকাঠামো।
জাতিসংঘ, আইসিআরসি (রেড ক্রস), ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা গাজাকে এখন ‘বাসযোগ্যতার নিচে’ বলে আখ্যা দিয়েছে। বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎ, ওষুধ—সব কিছুরই মারাত্মক সংকট। প্রায় ১৮ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় দিন পার করছে, যাদের একটি বড় অংশ শিশু। আর কোনো চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াই বহু মানুষ বোমার স্প্লিন্টার, পুড়ে যাওয়া দেহ বা অপুষ্টিতে ভুগছে।
গাজায় ইসরাইলের প্রতিদিনের আগ্রাসন ও সহিংসতা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে চলেছে। ৮২ জন ফিলিস্তিনির রোববারের মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছে—এই হত্যাকাণ্ডের শেষ কোথায়? যুদ্ধবিরতির যে উদ্যোগ চলছে, সেটি আদৌ বাস্তবে পরিণত হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। হামাস যদি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে থাকে, তবে ইসরাইলের অবস্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা চুক্তির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
এই মুহূর্তে গাজার জনগণ আশায় বুক বেঁধে আছে—তাদের জন্য হয়তো একটু শান্তি, একটু খাদ্য, একটু বেঁচে থাকার সুযোগ আসবে। তবে সেই আশার পেছনে এখনও দোদুল্যমান একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—মানবতা কি শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে, নাকি রাজনীতি ও শক্তির খেলায় গুঁড়িয়ে যাবে আরও হাজারো জীবন?
বাংলাবার্তা/এমএইচ