
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্য দেখিয়েছে যশোরের বেনাপোল কাস্টমস হাউস। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে প্রতিষ্ঠানটি। বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ী সংগঠন ও আমদানিকারকেরা এই অর্জনের কৃতিত্ব দিচ্ছেন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দুর্নীতি দমন এবং অবকাঠামো উন্নয়নকে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। তবে বছর শেষে এই আদায় গিয়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ২১ কোটি ৫১ লাখ টাকায়। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অতিরিক্ত আদায় হয়েছে ৩১৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এই সাফল্য শুধুই পরিসংখ্যানের নয়, বরং এটি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়নেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর পরিচালনা, শুল্ক আদায় প্রক্রিয়া এবং সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মধ্যে যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আরও বিস্তৃত পরিসরে রাজস্ব আহরণে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলপথে মোট বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাংশই বেনাপোল বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রতিবছর এই বন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি এবং ৮ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। এমন বিপুল পরিমাণ পণ্য প্রবাহ থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণের অন্যতম বড় উৎস হিসেবে বিবেচিত বেনাপোল কাস্টমস হাউস।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামিম হোসেন জানান, “বন্দরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিগত সময়ের তুলনায় অনেক বেশি বেড়েছে। এতে করে পণ্য খালাসের সময় কমে গেছে, রাজস্ব ফাঁকি রোধে ব্যবস্থা জোরদার হয়েছে, এবং আমদানিকারকেরা নিয়মনীতি মেনে চলতে উৎসাহী হয়েছেন।”
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কাস্টমসবিষয়ক সম্পাদক আব্দুল লতিফ বলেন, “যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, বিশেষ করে পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বেনাপোলের সংযোগ সহজ হয়েছে। ফলে বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ বেড়েছে, এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে।”
তিনি আরও জানান, আগে যেসব ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর ব্যবহার করতেন, তারা এখন অনেকেই বেনাপোল হয়ে আমদানি করছেন। কারণ এতে সময় ও খরচ—দুটিই কমে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে মোট ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ২ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। তবে এখনও কিছু জটিলতা রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পণ্য খালাসে বিলম্ব, কাস্টমস প্রক্রিয়ায় দেরি, এবং মাঝে মধ্যেই শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ব্যবসায়ীদের মধ্যে আছে।
আমদানিকারক ইদ্রিস আলী বলেন, “যত দ্রুত পণ্য খালাস সম্ভব, তত বেশি ব্যবসায়ী এই বন্দর দিয়ে পণ্য আনতে আগ্রহী হবেন। এতে সরকার আরও বেশি রাজস্ব পাবে। কিন্তু অনেক সময় আমরা দিনের পর দিন বন্দরে অপেক্ষা করি, এটা ব্যবসার জন্য বড় ক্ষতির কারণ।”
সাধারণ ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, “বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতির হার আগের চেয়ে অনেকটা কমেছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা এখন আরও বেশি জবাবদিহিমূলক আচরণ করছেন। এতে আমদানিকারকদের আস্থা বেড়েছে এবং সঠিক নিয়মে পণ্য খালাস করে রাজস্ব দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে।”
তিনি বলেন, “যদি এভাবে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যায় এবং শুল্ক ফাঁকি বা দালালচক্র নির্মূল করা যায়, তাহলে আগামী অর্থবছরে আরও বড় অঙ্কে রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।”
২০২৩-২৪ অর্থবছরেও বেনাপোল কাস্টমস হাউস রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে সময় ৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছিল ৬ হাজার ১৬৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা বেশি। তবে চলতি বছর অতিরিক্ত আদায়ের পরিমাণ আরও বেশি, যা বন্দর ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক উন্নতির ইঙ্গিত দেয়।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা। সরকারের রাজস্ব আহরণ সক্ষমতা যে বাড়ছে, তা এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। তবে আগামীতে এই অর্জন ধরে রাখতে হলে পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় জটিলতা কমানো, দুর্নীতি নির্মূল, আধুনিকায়ন এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলেই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরটি হতে পারে আরও বড় আকারে রাজস্ব আহরণের চালিকাশক্তি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ