
ছবি: সংগৃহীত
গাজায় সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকট ও সামরিক সংঘাতের অবসান ঘটাতে বিশ্ব সম্প্রদায় যখন যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে, তখন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, হামাস যদি গাজার ক্ষমতায় থাকে, তাহলে ইসরাইল কোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হবে না। তার এমন ঘোষণায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ফের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
রোববার (৬ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্র সফরে রওনা হওয়ার আগে তেলআবিবে দেওয়া বক্তব্যে নেতানিয়াহু এই কঠোর অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন, যেখানে গাজায় যুদ্ধবিরতি ও যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেন, “আমরা কোনো অবস্থাতেই এমন একটি চুক্তিতে যাব না, যেখানে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিডন্যাপার ও হত্যাকারীদের সঙ্গে শান্তি সম্ভব নয়। তাদের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংস না করে আমরা থামব না।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থেই গাজা থেকে হামাসের উপস্থিতি নির্মূল করতে হবে। আমরা এমন কিছু পরিস্থিতি তৈরি করব না, যাতে ভবিষ্যতে এমন গোষ্ঠী আবার উঠে আসে।”
নেতানিয়াহুর এ বক্তব্য এমন এক সময়ে এলো যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি দাবি করেছেন, গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি চুক্তি খুব শিগগিরই হতে পারে। ট্রাম্প জানান, হামাস তার প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে এবং ইসরাইলের সঙ্গেও তিনি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে বৈঠকে গাজা যুদ্ধ, হামাসের ভূমিকা, যুদ্ধবিরতির রূপরেখা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা শাসনব্যবস্থা কেমন হবে—এসব বিষয় আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউসের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো।
হোয়াইট হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই এমন একটি কাঠামো তৈরি করতে যেখানে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত হবে, কিন্তু সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ক্ষমতায় থাকবে না।”
অন্যদিকে, যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে হামাস, মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের মাধ্যমে। হামাসের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, তারা যুদ্ধ থামাতে আগ্রহী, তবে গাজার জনগণের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও পুনর্গঠনের বিষয়টি চুক্তির কেন্দ্রে থাকতে হবে।
নেতানিয়াহু এ সময় আরও দাবি করেন, “ইসরাইল সামনে এমন কিছু মুসলিম দেশের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করবে, যা কেউ কল্পনাও করেনি।” তিনি নাম উল্লেখ না করলেও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে জোর আলোচনা চলছে—সিরিয়া, লেবানন এমনকি সৌদি আরবের সঙ্গেও ইসরাইল হয়তো নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে।
তবে সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নয়, বরং গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা ফিলিস্তিনিদের রক্তের ওপর কোনো সম্পর্ক স্থাপন করব না। গাজার যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে—এটাই এখন প্রধান অগ্রাধিকার।”
এমন প্রেক্ষাপটে মনে রাখা দরকার, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন হয়েছে। গাজায় বেসামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানো, শিশু-নারী হত্যাসহ একাধিক অভিযোগে আইসিসি সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
এই অবস্থায় তার ‘হামাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি নয়’—এমন বক্তব্যকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবেও দেখছে।
নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফর ও কঠোর বিবৃতি এমন সময় এলো, যখন গাজা উপত্যকায় প্রতিদিনই অসংখ্য ফিলিস্তিনি প্রাণ হারাচ্ছেন। যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ও আন্তর্জাতিক আলোচনার মধ্যেই যখন একটি মানবিক বিরতির আশায় বুক বেঁধেছিল বিশ্ব, তখন নেতানিয়াহুর সরাসরি ‘না’ গোছের ঘোষণা যুদ্ধের স্থায়ীত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি ট্রাম্প প্রশাসন সত্যিই যুদ্ধবিরতি চায়, তাহলে ইসরাইলের ওপর চাপ তৈরি করেই কেবল সমাধানের পথ তৈরি করা সম্ভব। অন্যথায়, ইসরাইলের একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি ও ‘হামাস নিধন নীতি’ গাজাকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে ঠেলে দেবে।
এখন বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে ওয়াশিংটনের আলোচনার দিকে। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর বৈঠক শুধু একটি যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যত নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের পুরো ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপথ নির্ধারণ করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ