
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে চলমান ভয়াবহ বন্যা এখন রীতিমতো মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ জনে। শুধু কের কাউন্টিতেই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৮ জন মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে অন্তত ২৮ জন শিশু। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ, যাদের সন্ধানে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও নৌযানের সহায়তায় তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকারী বাহিনী।
বিশ্ব গণমাধ্যম বিবিসির বরাত দিয়ে জানানো হয়, নিখোঁজদের খোঁজে রাতদিন কাজ করছেন উদ্ধারকর্মীরা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, টেক্সাসের ওপর দিয়ে আরও ঝড়-বৃষ্টি আসছে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। এরই মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় জলস্রোত এতটাই প্রবল যে, উদ্ধার অভিযান বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
কের কাউন্টি পুলিশের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, উদ্ধার করা বেশ কিছু মরদেহের এখনো পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে নেওয়া গুরুতর আহতদের অনেকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং আশপাশের ক্লিনিকে। প্রশাসন জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত নিখোঁজ প্রত্যেককে খুঁজে না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই দুর্যোগের মাত্রা এতটাই বিশাল যে আমরা একে শুধুই প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে সীমাবদ্ধ করতে পারি না—এটি আমাদের রাজ্যের জন্য একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি।” তিনি জানান, ফেডারেল সরকারের সহায়তায় রাজ্যজুড়ে জরুরি অবস্থা বহাল রাখা হয়েছে এবং বিভিন্ন এলাকা ইতোমধ্যে জাতীয় গার্ড এবং জরুরি সহায়তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আনা হয়েছে।
গভর্নর আরও বলেন, “এখনো প্রায় ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন, আমরা তাদের খুঁজে বের করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। নিখোঁজদের প্রত্যেকের পরিবারের কাছে আমাদের প্রশাসন দায়বদ্ধ।” এ সময় তিনি ফেডারেল সরকারের সহায়তায় শুরু হওয়া ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কেও অবহিত করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বন্যাকে ‘দুর্যোগ’ নয়, বরং ‘জাতীয় ট্র্যাজেডি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি টেক্সাসবাসীর কষ্ট অনুভব করতে পারছি। এটা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। বিশেষ করে শিশুদের মৃত্যু হৃদয় বিদারক।”
ট্রাম্প আগামী শুক্রবার টেক্সাসের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলো পরিদর্শনের পরিকল্পনা করেছেন। তিনি জানান, তাঁর প্রশাসন গভর্নর অ্যাবটের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চলেছে এবং ফেডারেল পর্যায়ের সমস্ত সহায়তা দ্রুত পাঠানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, টেক্সাসের পশ্চিম-মধ্যাঞ্চলে আরও ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া টানা বৃষ্টিতে নদী-নালা, খাল-বিল উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। অনেক স্থানে সড়কপথ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও স্কুল-কলেজ পানিতে ডুবে আছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে বহু এলাকায়।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অনেকেই এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি। পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, মোবাইল টাওয়ার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রায় অচল। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে।
টেক্সাসের কের কাউন্টির এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন, “আমি আমার দুই সন্তানকে খুঁজে পাচ্ছি না। কাল রাত থেকে কোনো খোঁজ নেই। আমি শুধু তাদের ছবি নিয়ে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনছি আর আশা করছি কেউ একটা খবর নিয়ে আসবে।”
টেক্সাসের এ ভয়াবহ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা ইতোমধ্যে সহানুভূতি প্রকাশ করে জরুরি সহায়তা পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে প্রতিবেশী রাজ্যগুলো থেকেও ত্রাণ ও স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠানো হয়েছে।
টেক্সাসের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ এ বন্যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মৃত্যু ও নিখোঁজের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিদিন। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আপাতত, স্থানীয় প্রশাসন ও ফেডারেল সরকারের সমন্বয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া এবং সাধারণ জনগণকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সকল প্রচেষ্টা।
বাকি দুনিয়া তখন স্বাভাবিক—আর টেক্সাস এক গভীর বিষাদের অন্ধকারে ডুবে আছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ