
ছবি: সংগৃহীত
ইসলাম কেবল একটি ধর্মীয় বিশ্বাস নয়—এটি একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক, প্রতিটি কর্ম ও প্রতিটি সময়কে একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরিচালিত করে। এই ধর্মে সময়ের গুরুত্ব অত্যন্ত উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরআনে সুরা তাওবাহর ৩৬ নম্বর আয়াতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন—“নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মাসসমূহ বারোটি, আল্লাহর কিতাবে যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন।” এটি প্রমাণ করে, ইসলামি বর্ষপঞ্জির ১২টি মাস কোনো কাকতালীয় হিসাব নয়, বরং এটি এক নির্ধারিত সৃষ্টিক্রমেরই অংশ।
এই ১২টি মাস নিয়ে গঠিত হিজরি ক্যালেন্ডার বা ইসলামি বর্ষপঞ্জি, যেটির প্রতিটি মাস মুসলিমদের জীবনে এক একটি আধ্যাত্মিক পর্ব, শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার বাহক। প্রতিটি মাসের পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা, নবীজির (সা.) জীবনের শিক্ষা, সাহাবায়ে কেরামের আত্মত্যাগ, এবং আল্লাহর নির্ধারিত বিশেষ ইবাদতের সুযোগ। এই মাসগুলো কেবল সময়ের পরিমাপক নয়—বরং প্রতিটির রয়েছে একেকটি মূল্যবান তাৎপর্য, যেগুলো একজন মুসলমানের চিন্তা, চেতনা, আমল ও আত্মিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।
মুহাররম – ত্যাগের শিক্ষা ও আশুরার মহত্ত্ব
ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররমকে গণ্য করা হয় চরম পবিত্র মাস হিসেবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো মুহাররমের রোজা।” (সহিহ মুসলিম)। বিশেষ করে এই মাসের ১০ তারিখ, যা ‘আশুরা’ নামে পরিচিত, বহুবিধ ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক। এই দিনে ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার শহীদ হন কারবালার প্রান্তরে, যা মুসলিম উম্মাহর জন্য আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মুহাররম আমাদের শেখায়, সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করাও ঈমানের দাবি।
সফর – কুসংস্কার থেকে মুক্তির মাস
সফর মাসকে পুরাতন আরব সমাজ ‘অমঙ্গলের মাস’ বলে গণ্য করত। কিন্তু ইসলামী শিক্ষা আমাদের শেখায় যে, কালের কোনো অংশ অশুভ নয়। এ মাসে আবওয়া ও খাইবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি স্বাভাবিক মাস, যার মধ্যে যেমন আছে ইতিহাস, তেমনি আছে দায়িত্বশীলতার শিক্ষা। নবীজির সুন্নাহ অনুযায়ী, কুসংস্কার থেকে মুক্ত চিন্তায় এ মাসে আমল করা উচিত।
রবিউল আউয়াল – রাসূলের জন্ম ও হিজরতের মাস
মুসলমানদের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই মাসেই জন্মগ্রহণ করেন। এ মাসে তিনি মদিনায় হিজরত করেন, যেটিকে ভিত্তি ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। তাঁর জন্ম এবং হিজরতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আলো, আশ্রয়, দয়া ও পরিবর্তনের বার্তা। এ মাসে তাঁর জীবনাদর্শ পাঠ ও অনুসরণে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত।
রবিউস সানি – দায়িত্ব ও নেতৃত্বের শিক্ষা
যদিও এই মাসে নির্দিষ্ট ইবাদতের বিধান নেই, তবে ইতিহাসে দেখা যায়, রাসূল (সা.) এই মাসে সাহাবিদের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা করেছেন। এটি প্রমাণ করে, দায়িত্ব বণ্টন ও নেতৃত্বের বিকাশ ইসলামি সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
জুমাদা উল আউয়াল ও আখিরাহ – ইতিহাস, দুঃখ ও বিজয়ের মাস
এই দুই মাস ইসলামের ইতিহাসে নানা স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী। নবীজির স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বিবাহ, তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ইন্তেকাল, আবু বকর (রা.)-এর ওফাত এবং খলিফা ওমর (রা.)-এর দায়িত্ব গ্রহণসহ গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ যেমন ইয়ারমুক, সবই এ মাসে সংঘটিত হয়। মুসলমানদের আত্মত্যাগ, নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং মুসলিম শক্তির বিস্তার—এই সবই এই মাসগুলোর তাৎপর্য বহন করে।
রজব – মিরাজ ও ইবাদতের উচ্চতা
চারটি পবিত্র মাসের অন্যতম রজব মাস। এই মাসে সংঘটিত হয় নবীজির ইসরা ও মিরাজ, যেখানে তিনি আল্লাহর নির্দেশে আসমানে গমন করেন ও সালাতের ফরজ বিধান নিয়ে আসেন। রজব ইবাদতের মাস—এ সময় বেশি বেশি রোজা, তওবা, দোয়া ও ইবাদত করা মোস্তাহাব। মুসলমানের আত্মশুদ্ধির জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
শা’বান – প্রস্তুতির মাস
শা’বান মাসকে বলা হয় ‘রমজানের প্রস্তুতির মাস’। নবীজি (সা.) এই মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। ১৫ শা’বানের রাত, যা শবে বরাত নামে পরিচিত, বান্দার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার অপূর্ব সুযোগ। এ রাতের ইবাদত আল্লাহর রহমত অর্জনের অন্যতম উপায়।
রমজান – তাকওয়া, কোরআন ও কদরের মাস
পুরো হিজরি ক্যালেন্ডারের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রমজান মাস। এটি সিয়ামের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, কোরআন নাজিলের মাস এবং লাইলাতুল কদরের বরকতপূর্ণ রাতের মাস। এই মাসে রোজা ফরজ, দান-সদকা ও নেক আমলের প্রতিটি পদক্ষেপ বহুগুণ সওয়াবে পরিণত হয়।
শাওয়াল – ঈদ ও ধারাবাহিক ইবাদতের বার্তা
রমজানের পর আসে শাওয়াল, যেখানে মুসলমানরা ঈদুল ফিতরের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করে। এ মাসে ৬টি অতিরিক্ত রোজা রাখার ফজিলত রয়েছে, যা এক বছর রোজা রাখার সওয়াবের সমান। এটি আমাদের শেখায়, ইবাদত রমজানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সারা বছরের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
যুল ক্বাদা – যুদ্ধবিরতির শান্তিময় মাস
যুল ক্বাদা মাসেও যুদ্ধ নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) এই মাসে উমরাহ পালনে গিয়েছিলেন। এটি হলো ধ্যান, ইবাদত ও শান্তিপূর্ণ চর্চার সময়। মুসলমানদের জন্য এই মাস ইবাদতের এক প্রশান্ত সুযোগ।
যুল হিজ্জা – হজ ও কুরবানির চূড়ান্ত মাস
হিজরি বর্ষের শেষ মাস যুল হিজ্জা, যা হজের মাস। প্রথম ১০ দিন অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ, বিশেষ করে ৯ তারিখ আরাফার দিন ও ১০ তারিখ ঈদুল আজহার দিন। এটি আত্মত্যাগ, একতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতীক। হাজিদের জন্য এটি জীবনের শ্রেষ্ঠ ইবাদতের উপলক্ষ।
এই ১২টি মাস কেবল সময় পরিমাপের ধাপ নয়—বরং প্রতিটি মাসে লুকিয়ে আছে ইসলামের ইতিহাস, আত্মত্যাগের চিত্র, নবুয়তের আলো, এবং বান্দার আত্মিক উন্নতির দিকনির্দেশনা। মুহাররম আমাদের দৃঢ়তা শেখায়, রমজান আমাদের তাকওয়ার পথে চালিত করে, যুল হিজ্জা আমাদের ত্যাগ শেখায়—এইভাবে পুরো হিজরি বছরই একটি পরিপূর্ণ ইমানি জীবনের জন্য মানসিক, আধ্যাত্মিক ও আমলিক প্রস্তুতির সুযোগ এনে দেয়।
আসুন, আমরা ইসলামি ১২ মাসকে শুধু ক্যালেন্ডারে নয়—জীবনে বাস্তবায়নের সংকল্প গ্রহণ করি। তাহলেই আমরা হব সেই সৌভাগ্যবান মুসলিম, যারা সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব, ইনশাআল্লাহ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ