
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসী নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে নানা আলোচনা চললেও বাস্তবায়ন হয়নি। অনেকবার বিষয়টি উঠে আসলেও রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত নানা চ্যালেঞ্জের কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং নির্বাচন কমিশন (ইসি) এই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত উদ্যোগটি আগামী নির্বাচনে বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করছে। এর অংশ হিসেবে ইসি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময়, কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করেছে, যার মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের জন্য কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার বাস্তবায়নে ইসির প্রচেষ্টা
ইসির কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রাথমিকভাবে ভোট গ্রহণের জন্য প্রক্সি ভোট পদ্ধতির চিন্তা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, প্রক্সি ভোটে ভোটার যে প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, সেটি সঠিকভাবে প্রতিফলিত নাও হতে পারে, ফলে ভোটের স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাই প্রক্সি পদ্ধতির প্রতি ইসি এখন সীমিত আস্থা রাখছে।
অনলাইনে ভোট গ্রহণ ও পোস্টাল ভোট পদ্ধতিও আলোচনা হয়েছে। তবে অনলাইন ভোটিং প্রযুক্তিগত কারণে এখনও অধিকাংশ দেশে সফল হয়নি এবং অনেক ভোটার এতে আগ্রহী নন। এই কারণেই নির্বাচন কমিশন ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিকে প্রধান প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনা করছে, যেখানে ভোটাররা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করবেন এবং ভোট পাঠানো ও গ্রহণ করা হবে আধুনিক, নিরাপদ কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে।
ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালটের চ্যালেঞ্জ ও ব্যয়
ডাক বিভাগ, বেসরকারি কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান ফেডএক্স ও ডিএইচএল এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালটের সম্ভাব্য খরচ ও বাস্তবতা আলোচনা হয়েছে। এদের তথ্যমতে, ডাক বিভাগের ইএমএস সার্ভিস ব্যবহার করলে ভোটপ্রতি প্রায় ৫০০ টাকা খরচ হতে পারে। অন্যদিকে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করলে ভোটপ্রতি খরচ দাঁড়ায় ৫০০০ টাকা পর্যন্ত। এই বিশাল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথ্য প্রযুক্তি কমিটির বৈঠকে এসব খরচ ও প্রযুক্তিগত জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেখানে নির্বাচনী ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন এবং ভোট প্রক্রিয়াকে সহজতর ও সাশ্রয়ী করার জন্য আইটি বেইজড পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতির উন্নয়নে কাজ করার কথা জানিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা
গত ২৬ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ব্যাপক আলোচনা করেছেন। সেখানে প্রবাসী ভোটের ব্যয় ও কার্যকারিতা নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা হয়। সিইসি প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, যদি পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট নেওয়া হয়, তাহলে সরকারের জন্য এ ব্যাপারে বিপুল অর্থায়ন প্রয়োজন হবে।
এছাড়া প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ ও ভোটগ্রহণের কার্যকারিতা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, প্রবাসীদের অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে সীমিত পরিসরে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা হচ্ছে, যা ভোটগ্রহণ পদ্ধতির কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও সমর্থন
ইসি জানিয়েছে, প্রবাসী ভোটের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। মোট ১৮টি দল অনলাইন ভোটিংয়ের পক্ষে, ১৫টি দল পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছে। অন্যদিকে আটটি দল প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতির সমর্থক। এই মতামত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইসি তিনটি পদ্ধতির মধ্যে যেকোনো পদ্ধতি আইনগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে পর্যালোচনা করছে।
নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ জানিয়েছেন, ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি সহজতর ও ব্যয় সাশ্রয়ী করার জন্য কাজ চলছে। তিনি বলেন, “অনলাইন ভোটিং ও প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি এখনও বহু দেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং, তাই পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি এগিয়ে নিতে চাই আমরা।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এ বিষয়ে আইনি সংস্কার ও আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনটি পদ্ধতির ব্যবহারের সুযোগ রাখা হতে পারে যাতে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগ করা যায়।
গতিপ্রকৃতি ও সেমিনারগুলো
এ বছরের শুরু থেকে ইসি প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। গত ৮ এপ্রিল ওয়ার্কশপ আয়োজনের পাশাপাশি এপ্রিলের শেষদিকে ‘প্রবাসী ভোটারদের জন্য ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ শীর্ষক সেমিনার করা হয়। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও, বেসিস, সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সমন্বিত উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ
ইসির অ্যাডভাইজরি কমিটি গঠন করা হয়েছে প্রবাসী ভোটের পদ্ধতি নির্ধারণে। তারা প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ সহজ ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে সর্বোত্তম প্রযুক্তি ও পদ্ধতি নির্ধারণে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ডিজিটাল পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি সবচেয়ে বাস্তবসম্মত মনে করছে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
যদিও প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবুও ভোটের ব্যাপক বিস্তৃতি ও দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপূর্ণতায় এই উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন এই লক্ষ্য পূরণের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং নানা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে এবং দেশের উন্নয়নেও নতুন মাত্রা যোগ করবে। তাই নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর ও অর্থনৈতিক উপায়ে প্রবাসীদের ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কঠোরভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করবে, সেটাই প্রত্যাশা। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই স্বপ্ন পূরণের জন্য সকল পক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ