
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের জন্য ছিল এটি এক ঐতিহাসিক অভিযাত্রা। এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করে রোববার (৬ জুলাই) দিবাগত রাত প্রায় পৌনে ২টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেশে ফিরেছেন এই কৃতী নারী খেলোয়াড়েরা। যাত্রা শেষে বিমানবন্দর থেকে তাদের প্রথম গন্তব্য—ঢাকার হাতিরঝিল, যেখানে তাদের অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) আয়োজন করা বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
রাত গভীর হলেও দেশে ফেরার এই মুহূর্তটি ছিল উজ্জ্বল, গৌরবময় এবং আবেগঘন। আফিদা, ঋতুপর্ণা, তহুরা, শামসুন্নাহার—দলটির অন্যতম প্রধান তারকারা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই হাসিমুখে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে নিজেদের অনুভূতির কথা জানান।
নারী ফুটবল দলের দেশে ফেরার এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিমানবন্দরে খুব জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন না থাকলেও বাফুফের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন তাদের শুভেচ্ছা জানাতে। বাফুফে সাধারণ সম্পাদক, টিম ম্যানেজার এবং নারী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে নারী ফুটবলারদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন এবং মিষ্টিমুখ করান।
বাফুফে সূত্রে জানা গেছে, এবার পূর্বের মতো ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা না দেওয়া হলেও একটি বিশেষভাবে সাজানো বাসে দলকে নেওয়া হয়েছে। বাসটির গায়ে লাগানো ছিল নারী ফুটবল দলের অর্জনের ছবি এবং 'এশিয়ান কাপ ২০২৫ - বাংলাদেশ নারী দলকে অভিনন্দন' বার্তা।
বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সেই বাসে করেই নারী ফুটবল দল রওনা হন সংবর্ধনার প্রধান ভেন্যু হাতিরঝিলের এম্ফিথিয়েটার প্রাঙ্গণের উদ্দেশ্যে।
নারী ফুটবল দলের এশিয়ান কাপ নিশ্চিত করার কৃতিত্বকে সামনে রেখে হাতিরঝিল এম্ফিথিয়েটারে আয়োজন করা হয়েছে এক জমকালো শুভেচ্ছা ও সম্মাননা অনুষ্ঠান। এতে উপস্থিত রয়েছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণসহ বাফুফের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নারী ফুটবলারদের হাতে স্মারক তুলে দেওয়ার পাশাপাশি ছিল সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা পর্ব। সেখানে কৃতিত্বপূর্ণ পারফরম্যান্সের জন্য খেলোয়াড়দের শুভেচ্ছা জানানো হয় এবং পরবর্তী প্রস্তুতির দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাফুফে সভাপতি বলেন, “এই মেয়েরা বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তারা শুধু মাঠে জয় পায়নি, তারা সবার মন জয় করেছে। এই অর্জন দেশের নারী ক্রীড়ার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত।”
২০২২ ও ২০২৪ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল বিশ্বমঞ্চে নিজেদের একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে। সেই সময় ছাদখোলা বাসে শহর প্রদক্ষিণ করে সংবর্ধনা পেয়েছিলেন ফুটবলাররা। জনতার বাঁধভাঙা ভালোবাসা ছিল এই মেয়েদের প্রতি।
এবারের এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বেও নারী দল অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। পরপর কয়েকটি ম্যাচে আধিপত্য দেখিয়ে তারা মূল পর্বে খেলার টিকিট নিশ্চিত করে। এই অর্জনকে কেবল একটি ক্রীড়া সাফল্য নয়, বরং সামাজিকভাবেও নারীর অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দেশে ফেরার পর গণমাধ্যমে কথা বলেন অধিনায়ক ঋতুপর্ণা চাকমা। তিনি বলেন, “আমরা খুব খুশি, গর্বিত। এশিয়ান কাপে জায়গা করে নিতে পেরে আমরা দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে মূল পর্বে ভালো খেলা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দৃঢ় করা।”
সিনিয়র ফরোয়ার্ড তহুরা খাতুন বলেন, “এই জয় শুধুমাত্র আমাদের না, এটি দেশের নারীদের বিজয়। যারা স্বপ্ন দেখে, তারা যেন আমাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়, সেই চেষ্টাই আমরা করি।”
বাফুফের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মূল পর্বে অংশ নেওয়ার জন্য শিগগিরই একটি উন্নত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু হবে। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে প্রস্তুতি ম্যাচ আয়োজনেরও পরিকল্পনা রয়েছে।
এশিয়ান কাপের মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছর, যেখানে অংশ নিতে যাওয়া বাংলাদেশের নারী দল এবারই প্রথম। এটি দেশের ফুটবল ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল এখন আর কেবল একটি দল নয়—তারা হয়ে উঠেছেন লাখো নারীর অনুপ্রেরণা, সাহসের প্রতীক এবং সম্ভাবনার প্রতিচ্ছবি। সীমাবদ্ধতার ঘেরাটোপ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মানের পারফরম্যান্স করা এই মেয়েরা প্রমাণ করেছেন, সুযোগ ও প্রশিক্ষণ পেলে তারাও বিশ্ব জয় করতে পারে।
দেশে ফেরা, সংবর্ধনা, হাসিমুখ—সবকিছু মিলিয়ে রাতটি হয়ে উঠেছে একটি জাতির গর্বের মুহূর্ত। আর এই মুহূর্তের পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর কষ্ট, প্রস্তুতি, সংগ্রাম আর অদম্য মনোবল।
এই জয়গাঁথা শুধু আজকের নয়, এটি আগামী দিনের নারীকেন্দ্রিক ক্রীড়াচর্চার বড় ভিত্তি হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ