
ছবি: সংগৃহীত
গড়ে তোলা হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী, কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে সেটিই আজ দুর্নীতির করাল গ্রাসে ধসে পড়তে বসেছে। হাজার কোটি টাকার সরকারি বিনিয়োগ, উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন, এবং দেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত—সব মিলিয়ে যে প্রকল্পটি তৈরি হয়েছিল, সেই সাভারের ট্যানারি নগরী এখন রূপ নিয়েছে এক ব্যর্থ প্রকল্পে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সিইটিপিকে ঘিরে দুর্নীতি, অযোগ্যতা ও রাজনৈতিক প্রভাবের জটিল জালে জড়িয়ে ধুঁকছে পুরো শিল্পটি।
সাভারে সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) নির্মাণে একের পর এক অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে—১২ দফায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৪৭ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় হিসেবে শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এমন প্রকল্পে সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি টাকা ব্যয় যথেষ্ট ছিল। অর্থাৎ বাকি ৩৭৭ কোটি টাকা গায়েব—যা সোজা ভাষায় লুটপাট।
চামড়া খাত সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এই ৫৪৭ কোটি টাকার মধ্যে ৮৭.২ শতাংশ অর্থ মূলত আত্মসাৎ হয়েছে। খরচ করা হয়েছে কেবল ১২.৮ শতাংশ। এই তথ্য কেবল সংখ্যায় নয়, বাস্তবতার সঙ্গেও মিলে গেছে। প্রকল্পে যেভাবে হিসাব দেখানো হয়েছে, বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না।
সিইটিপি পরিকল্পনা অনুযায়ী দৈনিক ২৫ হাজার কিউবিক মিটার তরল বর্জ্য শোধনের কথা। কিন্তু বাস্তবে এর সক্ষমতা মাত্র ১৪ হাজার কিউবিক মিটার। ফলে প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার কিউবিক মিটার বিষাক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত বর্জ্য সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “সিইটিপি যদি ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে পরিবেশ রক্ষা নয়, বরং একে ধ্বংস করার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। ধলেশ্বরীর যা অবস্থা, তা দেখে বোঝা যায় এখানে ‘পরিবেশবান্ধব’ শব্দটি পুরোপুরি উপহাসে পরিণত হয়েছে।”
বিসিক দাবি করেছিল, সাভারের হেমায়েতপুরে ‘পরিবেশবান্ধব’ শিল্পনগরী গড়ে উঠবে। ইউরোপের ক্রেতা আসবে, দাম বাড়বে, এলডব্লিউজির সনদ মিলবে—এইসব আশ্বাসেই হাজারীবাগ থেকে শত শত ট্যানারি কারখানা সরিয়ে সাভারে আনা হয়।
আরব লেদারের স্বত্বাধিকারী মো. ইলিয়াসুর রহমান বলেন, “যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, বাস্তবে আমরা সেই স্বপ্নে ফাঁদে পড়েছি। এখন এমন অবস্থায় পৌঁছেছি যে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, “সিইটিপি নিয়ে শুরু থেকেই ভুল ছিল। বুয়েট পর্যন্ত প্রাথমিক বর্জ্য নিরূপণের কাজটা ঠিকভাবে করেনি। হাজারীবাগে ও সাভারে তরল বর্জ্যের তুলনামূলক পরিসংখ্যান ছাড়া একটা এত বড় প্রকল্প কিভাবে বাস্তবায়ন হলো, সেটাই প্রশ্ন।”
তিনি আরও বলেন, “প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল ১২ হাজার কিউবিক মিটারের রিপ্লায়ার থাকবে। পরে বলা হলো ২৫ হাজার দরকার। কিন্তু বাস্তবে ১৪ হাজারও কাজ করছে না ঠিকমতো।”
সিইটিপি নির্মাণে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও তাদের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই প্রজেক্ট বিসিকের কাছে হস্তান্তর করে চম্পট দেয়। সেই অসম্পূর্ণ সিইটিপির দায়-দায়িত্ব এখন বিসিক এবং সরকারের কাঁধে।
এ নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক সাবেক অতিরিক্ত সচিব বলেন, “চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির প্রতিটি ধাপে জবাবদিহির ঘাটতি ছিল। হস্তান্তর-পরবর্তী যাচাই বা কোনো আর্থিক জরিমানা ছাড়া তারা কিভাবে চলে যেতে পারল, সেটা ভাবতেই অবাক লাগে।”
২০২০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় সিইটিপি পরিচালনার জন্য ৩০ কোটি ১১ লাখ টাকা অনুদান দেয়। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই অর্থের বড় একটি অংশ বিল-ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
জুলাই ২০২১ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ২৩টি খাতে এই অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি খাতে অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যয় হয়েছে—জনবল, সম্মানী ভাতা, যানবাহন ভাড়া, কমিটি মিটিং ইত্যাদি। মজার ব্যাপার হলো, তখনো সিইটিপি কার্যকরভাবে চালু হয়নি।
ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট কোম্পানির ম্যানেজার জাভেদ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “মেশিনারিজ ছিল নতুন। সেগুলো রিপ্লেস করা তো হাস্যকর ব্যাপার। এই বিল দেখলেই বোঝা যায় অর্থ আত্মসাতের কৌশল কতটা ভয়াবহ।”
সেই সময়ে দায়িত্বে থাকা মোস্তাক আহমেদ, যিনি বর্তমানে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক, তিনি বলেন, “সব ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী হয়েছে এবং প্রতিটি খাতে বিল-ভাউচার রয়েছে। অনিয়ম হয়নি।”
তবে তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া নথিপত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, বাস্তব চিত্র তার দাবির বিপরীত।
এবিএস ট্যানারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইমাম হোসাইন বলেন, “সিইটিপির কারণে আমরা এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট পাচ্ছি না। আন্তর্জাতিক বাজারে জায়গা হারাচ্ছি। শুধু সিইটিপির ব্যর্থতায় বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার রপ্তানি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।”
সাভারের শিল্পনগরী যেখানকার মাত্র ৩টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য, সেখানে ভারতের বানতলা লেদার কমপ্লেক্সে সদস্যসংখ্যা ১৩৯টি। রপ্তানি আয়ে ভারতের চামড়া খাত এগিয়ে গেছে বহুগুণ। বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত শুধুই দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং অনিয়মে ধ্বংসের পথে।
সাভারের ট্যানারি শিল্প এখন জীবন্ত অথচ ধুঁকতে থাকা একটি নজির—যেখানে সরকারি বিনিয়োগ, উদ্যোক্তাদের শ্রম ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সব একসাথে ব্যর্থ হয়েছে একটি সঠিক পরিকল্পনা, কার্যকর বাস্তবায়ন ও স্বচ্ছতার অভাবে।
সিইটিপি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বিচার বিভাগীয় তদন্ত, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে শুধু সাভার নয়, দেশের চামড়া খাতই হয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক বর্জ্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ