
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ সম্প্রসারণ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তীব্র টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তিগত চাহিদার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি ব্যান্ডউইথ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পটি প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এগোচ্ছিল, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও সরকারি সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত ও প্রতিবাদের মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব কর্তৃক দুদককে সরাসরি চিঠি দিয়ে প্রকল্পটি চালিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করার তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকল মহলে বড় ধরনের বিতর্ক ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বর্তমানে দেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশের মোট ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের প্রায় ১০০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। বিটিসিএল বর্তমানে মাত্র ৭ টেরাবাইট ক্ষমতার অবকাঠামো ব্যবহার করছে। এ অবস্থায় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ‘ফাইভজি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যার খরচ ছিল প্রায় ২৮ লাখ টাকা। বুয়েটের সমীক্ষায় দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ব্যান্ডউইথ চাহিদা ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৬.২ টেরাবাইট নির্ধারণ করা হয়।
তবে মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট বুয়েটের সুপারিশ উপেক্ষা করে ২৬ টেরাবাইটের পরিবর্তে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেয়, যা দরপত্রের সময় প্রায় ৩২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় পরিকল্পিত ছিল। এই অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্রপাতি ৬-৮ বছরের মধ্যেই প্রযুক্তিগতভাবে অকেজো হয়ে পড়ার শঙ্কা থাকলেও অর্থের স্রোত থামানো যাচ্ছিল না। দুর্নীতির অভিযোগে দুদক তদন্ত শুরু করলে প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও মন্ত্রণালয়ের একটি গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে প্রক্রিয়াটি পুনরায় সচল করার চেষ্টা চালায়।
দুদক তদন্তে বাধা দিতে ও প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ২২ জুন একটি আধাসরকারি চিঠি দুদক চেয়ারম্যানের কাছে পাঠান। এতে তিনি প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন এবং বলেন, এটি দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য অত্যাবশ্যক। তিনি আরও যুক্তি দেন, বিটিসিএলের প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া রোধ, ৫জির রেডিনেস বজায় রাখা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য হ্রাসের জন্য এই প্রকল্প অপরিহার্য। এছাড়া তিনি দাবি করেন, প্রকল্পটি বন্ধ করলে সরকারের প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নষ্ট হবে।
দুদকের একটি শীর্ষ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, “এ ধরনের চাপ প্রয়োগ দুদকের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ। এমন কর্মকাণ্ড আইনগতভাবে দণ্ডনীয় এবং দুদক কখনোই এই ধরনের প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়।”
বুয়েটের সমীক্ষায় ব্যবহার করা সূত্র অনুযায়ী, ২০৩০ সালের জন্য দেশের সর্বোচ্চ ব্যান্ডউইথ চাহিদা ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইটের বেশি হবে না। বুয়েট বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমান অবকাঠামোর সক্ষমতা এবং দেশে ডিজিটাল ব্যবহার বৃদ্ধির ধারা বিবেচনায় এটি যুক্তিযুক্ত। তবে অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ কেনা অর্থ অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
টিআইবি (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যদি প্রকল্পের সুষ্ঠু কস্ট-বেনিফিট বিশ্লেষণ এবং নিরপেক্ষ পর্যালোচনা না করা হয়, তাহলে এমন প্রকল্প শুধু দুর্নীতির জন্ম দেয়। তদন্তাধীন প্রকল্পে যেকোনো ধরনের ছাড় দেওয়া বা প্রভাব বিস্তার করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মইদুল ইসলাম বলেন, “কোনো প্রতিষ্ঠান দুদকে এ রকম চিঠি দিতে পারেন না। এটি দুদকের কাজের স্বাধীনতায় বাধা দেয়। দুদক প্রকল্প চালানো বা বন্ধ করার জন্য নয়, বরং দুর্নীতির তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।”
এই প্রকল্প নিয়ে সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বাব ও সাবেক সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল, যাদের পছন্দের ঠিকাদারদের নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী দরপত্র বাতিল করায় তাকে হয়রানির শিকার হতে হয়। পরে দুর্নীতি অভিযোগে তাকে এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা করা হয়। কিন্তু আদালতের হস্তক্ষেপে মামলাগুলো স্থগিত আছে।
প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির জন্য নতুন করে সরাসরি চাপ দেওয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বতন্ত্র তদন্তে বাধা দেওয়া এবং সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা, দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
হুয়াওয়ের দক্ষিণ এশিয়া কমিউনিকেশন প্রধান তানভীর আহমেদ বলেন, “আমরা নিয়ম মেনে কাজ করছি, প্রকল্প নিয়ে ঝামেলা চললেও আমরা ইচ্ছুক কাজটি শেষ করতে।” তিনি দুদকের সাবেক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের সমালোচনা করে বলেন, “তিনি কেন এ ধরনের মন্তব্য করলেন, তা বুঝতে পারছি না।”
অন্যদিকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মো. জহিরুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছেন, “আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।”
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, “অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা স্পষ্ট এবং এটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্প চালিয়ে নেওয়ার যে ধরনের প্ররোচনা বা চাপ দেওয়া হচ্ছে, তা দুর্নীতির তদন্তে বাধা হিসেবে গণ্য হয়।”
সাবেক দুদক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মইদুল ইসলাম বলেন, “দুদক শুধু দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার করে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্প চালাতে বা বন্ধ করতে বলে না। প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন সরকারের অন্য সংস্থার বিষয়।”
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমার উদ্দেশ্য সরকারের অর্থ সাশ্রয় এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করা। প্রকল্প বন্ধ করলে ২৯০ কোটি টাকার পেমেন্ট বাতিল হবে, যা মারবে। আমি দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি, বুয়েট ও ঢাবির বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি যাতে প্রকল্পে আসা যন্ত্রপাতি সঠিক হয়। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম থাকলে দুদক শাস্তি দিতে পারে।”
তিনি আরো বলেন, “বিটিসিএলের বিরুদ্ধে অপব্যবহার আর মন্ত্রীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তার চলছে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে দিতে চায়।”
এই বিতর্কিত প্রযুক্তি প্রকল্প দেশের ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও দুর্নীতির ছায়ায় তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সরকারি অর্থের অপচয় ও স্বচ্ছতার অভাব দেশের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। দুদকের স্বাধীনতা রক্ষা ও প্রকল্পের প্রকৃত প্রয়োজন যাচাইয়ে সুষ্ঠু তদন্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় উভয়েরই এ বিষয়ে স্পষ্ট ও জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি উদ্বেগ ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দেশের প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এর প্রভাব সম্পর্কে জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাই সজাগ নজর রাখছে।
বাংলাবার্তা/এসজে