
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে দলের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের একাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। বিশেষ করে ‘হাইব্রিড’ ও ‘নব্য বিএনপি’ নামধারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় একপ্রকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে বিএনপি। এরই মধ্যে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন অন্তত পাঁচ হাজার নেতাকর্মী, এবং এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে শোকজ করা হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যাদের বিরুদ্ধে জনমনে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে বা যারা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যন্ত প্রতিটি কমিটি পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলছে। যেখানে নেতাকর্মীদের অতীত, জনপ্রিয়তা, জনসম্পৃক্ততা এবং শৃঙ্খলার প্রশ্নে তদন্ত করা হচ্ছে। দলীয় সূত্র বলছে, যেসব এলাকায় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকাকে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এদের বিরুদ্ধে দলীয় ও প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, “দল এবং দেশের স্বার্থে বিএনপি যা যা করা দরকার তাই করবে। যারা দলের ইমেজ নষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বিএনপি মোটেই দ্বিধা করবে না।” তিনি আরও বলেন, “৫ আগস্টের পর বিএনপির রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন এসেছে। যারা এ পরিবর্তনের ধারায় না গিয়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে, তারা দলে টিকতে পারবে না।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমরা বহুবার নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছি, আওয়ামী লীগ যেসব অপকর্ম করে দেশে বদনাম করেছে, বিএনপি যেন সেই পথ না ধরে। দলের পক্ষ থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু যারা বেপরোয়া আচরণ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং নেব।”
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “দলের নামে কেউ অপকর্ম করলে রেহাই পাবে না। আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। ইতোমধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
সম্প্রতি কুড়িগ্রামের চিলমারীতে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় যুগ্ম আহ্বায়ক সাঈদ হোসেন পাখি এবং সদস্য আবদুল মতিন শিরিনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার পাছথুবী ইউনিয়নের বিএনপি নেতা খোকন মিয়াকেও বহিষ্কার করা হয়, কারণ তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থানায় হামলার ঘটনায় পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদ হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ঢাকার বনানী থানার যুবদলের আহ্বায়ক মুনির হোসেনকেও বহিষ্কার করা হয় নারীদের ওপর হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কাউন্সিলর হারুনুর রশিদ হারুনকে চাঁদাবাজি ও বাড়ি দখলের অভিযোগে শোকজ করা হয়েছে। তবে তার জবাব পাওয়ার পরও সিদ্ধান্ত স্থগিত রয়েছে আহ্বায়ক দেশের বাইরে থাকায়।
দলীয় নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির দুর্দিনে যারা পাশে ছিল না, বরং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে গোপন আঁতাতে যুক্ত থেকে ব্যবসা করেছেন, তারাই এখন নানা উপায়ে দলের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করছেন। এদের অনেকেই আগে আওয়ামী লীগপন্থী ছিলেন, এখন বিএনপির নাম ব্যবহার করে দলে অনুপ্রবেশ করেছেন। ফলে ত্যাগী ও দুঃসময়ের নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। এসব হাইব্রিড এবং ‘পুশইন’ চক্রই অধিকাংশ অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করছে হাইকমান্ড।
তৃণমূল নেতাদের বহুবার সতর্ক করা সত্ত্বেও কিছু জায়গায় চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অস্ত্রধারীদের দলে জায়গা করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে তদন্তে সুনির্দিষ্ট প্রমাণও পেয়েছে বিএনপি। এজন্য ভবিষ্যতে মনোনয়ন বা পদবন্টনের ক্ষেত্রে এসব বিষয় কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শুধু সাংগঠনিক ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ না থেকে বিএনপি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে মামলা দায়েরও করা হয়েছে। সূত্র জানায়, দলের ইমেজ রক্ষায় হাইকমান্ড এখন আর কোনো আপস করতে নারাজ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, “বিএনপির এখনই সময় নিজেদের ক্লিন ইমেজ তুলে ধরার। জনগণ অনেক সচেতন হয়ে গেছে। তারা অপরাধীদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক মেনে নেয় না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েই বিএনপির সামনে এগোনো উচিত। না হলে এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দলের জন্য বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
বিএনপির শুদ্ধি অভিযানের এই উদ্যোগ দলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পাঁচ আগস্টের পর নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জনসম্পৃক্ত ও নৈতিক রাজনীতির যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হলে অপকর্মকারীদের সরিয়ে দেওয়াই একমাত্র উপায়। নেতাদের ভাষ্যমতে, দল এখন আর আগের মতো দুর্বল নয়—শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা এবং জনগণের আস্থা অর্জনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। হাইব্রিড, পুশইন ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিলে বিএনপির ইমেজ নতুনভাবে গড়ে উঠতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে ধারাবাহিক, নিরপেক্ষ ও আপসহীন পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ