
ছবি: সংগৃহীত
গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কতটা স্বাধীন ছিল, তা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তদন্ত করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, বিগত শাসনামলে সাংবাদিকরা কতটা নিয়ন্ত্রিত ছিলেন এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ তৈরি করতে উদ্যোগ নিচ্ছে, তা নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। সেই সঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের জন্য ন্যূনতম বেতন ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করার কথাও জানান।
শনিবার (৫ জুলাই) সকালে রাজধানীর ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) আয়োজনে এক পর্যালোচনা ও মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। সভায় দেশের সম্প্রচার সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, পেশাগত নিরাপত্তা এবং সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
প্রেস সচিব বলেন, “বিগত সরকারগুলোর সময়ে সাংবাদিকতা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ছিল। অনেক সময় সরাসরি চাপ প্রয়োগ, আবার কখনো নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালার মাধ্যমে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এটি কেবল মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই খর্ব করেনি, বরং পুরো গণতান্ত্রিক চর্চাকেই বাধাগ্রস্ত করেছে।”
তিনি জানান, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে যে তদন্ত হবে, তা হবে একটি নিরপেক্ষ ও প্রামাণ্য প্রক্রিয়া, যেখানে সাংবাদিক, গবেষক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হবে। এই তদন্তে বিগত শাসনামলে কত সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, কতজন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছেন কিংবা কত সংবাদমাধ্যম বন্ধ হয়েছে বা চাপের মুখে নীতিবিবর্জিত অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে—সেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “বর্তমানে কোনও সংস্থা বা গোয়েন্দা বিভাগ যাতে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি দেখাতে না পারে, সেজন্য বিশেষভাবে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশ্বাস করে, স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “এখন সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের মত প্রকাশে স্বাধীন। সরকার সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করছে না, এবং এটা নিশ্চিত করতেই গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দিকেও আমরা আগাচ্ছি।”
সভায় উপস্থিত ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমানে সাংবাদিকতা একটি অস্থির ও অনিরাপদ পেশায় পরিণত হয়েছে। সরকারি বা বেসরকারি মালিকানাধীন অনেক গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের বেতন, নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। তাই সম্প্রচার সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কমিশন গঠন, সাংবাদিকতার জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ এবং আলাদা বেতন কাঠামো প্রবর্তনের দাবি জানানো হয়।
তারা অভিযোগ করেন, চার মাস আগে জমা দেওয়া গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এখনো সরকারিভাবে প্রকাশ পায়নি, এমনকি বাস্তবায়নের ব্যাপারেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এতে তারা হতাশা প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানান।
শফিকুল আলম বলেন, “বর্তমানে সাংবাদিকদের যেসব বেতন দেওয়া হচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই মানবেতর। আমরা চাই, অন্তত ন্যূনতম বেতন ৩০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হোক। এজন্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।”
তিনি আরও জানান, গণমাধ্যমকে টেকসই ও পেশাভিত্তিকভাবে শক্তিশালী করতে হলে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সংবাদ সংস্থাগুলোরও উচিত সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা।
সভায় জানানো হয়, জাতিসংঘের তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা সুরক্ষা কর্মপরিকল্পনা’ তৈরি করা হবে। এই পরিকল্পনায় থাকবে—সাংবাদিকদের সুরক্ষা নীতিমালা, তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সংবাদ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার প্রতিরোধ।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে একটি নতুন কাঠামো তৈরির কথাও আলোচনায় আসে, যেখানে সাংবাদিকদের কল্যাণ তহবিল, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও মানোন্নয়ন প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
১৫ বছরের সাংবাদিকতা নিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই তদন্ত শুধু অতীতের বিচার নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন। শফিকুল আলমের বক্তব্যে স্পষ্ট—সাংবাদিকতার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং মুক্ত, পেশাগত ও নিরাপদ সাংবাদিকতা ব্যবস্থাই হতে চলেছে সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। তবে এই প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে সরকার, গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক সমাজের যৌথ দায়বদ্ধতার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ