
ছবি: সংগৃহীত
চুয়াডাঙ্গার সড়কে আবারও প্রাণ গেল তিনজনের। এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন একজন ইজিবাইকচালকসহ তিনজন যাত্রী। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত পাঁচজন, যাদের মধ্যে একজন নারী ও তার ছয় মাসের শিশু সন্তানও রয়েছে।
শুক্রবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার জাফরপুর এলাকায় বিজিবি-৬ ব্যাটালিয়নের ক্যাম্পসংলগ্ন বনবিভাগ কার্যালয়ের সামনে এই দুর্ঘটনা ঘটে। জাফরপুর এলাকায় গাছের ডাল রাস্তার ওপর পড়ে থাকার কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইজিবাইকটি তেলবাহী একটি ট্রাকের সামনে চলে গেলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই দুইজন এবং হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়। আহতদের দ্রুত চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন—চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হিজলগাড়ি গ্রামের মৃত ইরাদ শেখের মেয়ে হোটেল কর্মচারী মাছুরা খাতুন (৫০), চুয়াডাঙ্গা শহরের মুসলিমপাড়ার মৃত রহম আলী মুন্সীর ছেলে কাপড় ব্যবসায়ী আবু তালেব মুন্সী (৬৫), এবং দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে ইজিবাইকচালক আরিফুল ইসলাম (২৪)।
তাদের মধ্যে মাসুরা খাতুন ও আবু তালেব ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত্যু হয় চালক আরিফুল ইসলামের। এই দুর্ঘটনা শুধু একটি ইজিবাইক নয়, তিনটি পরিবারকে চিরতরে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিল।
আহতদের মধ্যে আছেন—চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এবং সিপি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার দেলোয়ার গাজী; দামুড়হুদার ছোটদুধপাতিলা গ্রামের বাসিন্দা ও পিএসপি পাইপ কোম্পানির কর্মচারী মামুন হোসেন (২২); চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হায়দারপুর গ্রামের সারব্যবসায়ী ফাহাদ আহমেদ (২৩), তার স্ত্রী প্রিয়া খাতুন (২০) এবং তাদের ছয় মাস বয়সী শিশু সন্তান সাইম।
চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, আহতদের মধ্যে দেলোয়ার গাজীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। শিশুসন্তান সাইমকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তরের চেষ্টা চলছে। বাকিদের অবস্থাও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, দুর্ঘটনার পরপরই যদি স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার কাজে এগিয়ে না আসতেন, তবে প্রাণহানি আরও বাড়তে পারত।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় যুবক রাকিব হোসেন। তিনি বলেন, “রাস্তায় বড় একটি গাছের ডাল পড়ে ছিল। ইজিবাইকটি বনবিভাগ অফিসের সামনে পৌঁছালে সেই ডালটি দেখে চালক হঠাৎ ব্রেক কষে। এই সময় চুয়াডাঙ্গা থেকে ছেড়ে আসা ঝিনাইদহমুখী একটি তেলবাহী ট্রাক মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে ইজিবাইক দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আমি তখনই দৌড়ে গিয়ে স্থানীয়দের ডাক দেই এবং সবাই মিলে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খালেদুর রহমান বলেন, “দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। মৃতদেহগুলো চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে এক নারীর পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করার প্রস্তুতি চলছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—রাস্তার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কতটা ঘাটতি রয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ডাল বা অন্য প্রতিবন্ধকতা দুর্ঘটনার বড় কারণ হতে পারে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উচিত নিয়মিত এসব বিষয়ে নজর দেওয়া।”
এই সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন শত শত যানবাহন চলাচল করে। অথচ স্থানীয় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কিংবা বনবিভাগের কেউ নিয়মিতভাবে সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। গাছের ডাল পড়ে থাকলেও তা অপসারণে কোনো জরুরি উদ্যোগ ছিল না।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, “এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি অবহেলার ফল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আগে থেকেই সতর্ক হতো, তাহলে হয়তো তিনটি প্রাণ এভাবে অকালে ঝরে যেত না।”
তিনজন নিহতের পরিবারে এখন শোকের মাতম চলছে। ৬৫ বছর বয়সী ব্যবসায়ী আবু তালেব মুন্সী তাঁর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। মাছুরা খাতুন স্থানীয় একটি হোটেলে কাজ করে সংসার চালাতেন। চালক আরিফুল ইসলাম বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় করছিলেন বলে জানান তাঁর পরিবার। তাদের হঠাৎ মৃত্যুতে পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, জনপ্রতিনিধি এবং দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অবিলম্বে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। রাস্তায় ঝুঁকিপূর্ণ গাছ, ডাল, গর্ত এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা দ্রুত অপসারণের দাবিও তোলেন তারা।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, এই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে। দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিদিনের মতো চলতে থাকা জীবনের হঠাৎ থেমে যাওয়া—এই দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, অবহেলা কতটা ভয়াবহ হতে পারে। একটি গাছের ডাল, একটি অসতর্ক ট্রাকচালক কিংবা অনিয়মতান্ত্রিক যান চলাচল—সবকিছু মিলে কেড়ে নেয় মূল্যবান প্রাণ। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। প্রশাসনের এখনই উচিত এ ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা—কারণ প্রতিটি প্রাণই অমূল্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ