
ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘মব সন্ত্রাস’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতা হঠাৎ করে একটা ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ ভয় এবং উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে, অপরাধীরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়া এবং গণপিটুনি দিয়ে নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে। একের পর এক ঘৃণ্য গণপিটুনির ঘটনা এবং প্রকাশ্য স্থানে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। দেশজুড়ে এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারি উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যত খুব সীমিত সাফল্য পাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি গ্রামে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে একদল গ্রামবাসী মা, ছেলে ও মেয়েকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। নিহতরা হলেন ৫৫ বছর বয়সী রোকসানা আক্তার রুবি, তার ছেলে ৩৮ বছর বয়সী রাসেল মিয়া ও মেয়ে ৩২ বছর বয়সী জোনাকী আক্তার। মৃত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার জানান, ‘মানুষ মানুষকে এভাবে পিটিয়ে মারা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন।’
পুলিশ এসপি নাজির আহমেদ খান জানান, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে, তবে এখনও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। এমন ঘটনা মাত্র এক সপ্তাহ আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ১৯ বছর বয়সী শ্রমিক হৃদয় পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘মব সন্ত্রাস’ থামেনি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে ২৫৩টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৬৩ জন নিহত ও ৩১২ জন আহত হয়েছেন। মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানগুলো ভয়ংকর। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এককভাবে ৭৮ জন নিহত হয় গণপিটুনিতে। এ ধরনের সহিংসতায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
গণপিটুনির ঘটনার পেছনে অভিযোগ থাকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ যেমন: চুরি, ছিনতাই, কটূক্তি, প্রতারণা থেকে শুরু করে গুরুতর অপরাধ যেমন ধর্ষণ, খুন, অপহরণ। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মব সন্ত্রাসের পেছনে রয়েছে সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং আইনের শাসনের অভাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মন্তব্য করেন, “মব সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে নিরুৎসাহিত হওয়া চলবে না। রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভুক্ত মব যারা তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন।”
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, “আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচার দেওয়া চলবে না, এটা একটি সভ্য সমাজে কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।”
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম স্বীকার করেন যে, মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশের একক দায়িত্ব নয়, বরং সব নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। তিনি বলেন, “অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হবে না। যারা পুলিশের কাজের বাধা দিচ্ছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।”
বিএনপি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা মব সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও সমালোচনা করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “মব সন্ত্রাস কোনো সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। অপরাধের বিচার হবে আদালতে, রাস্তায় নয়। সরকারকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
বাম গণতান্ত্রিক জোটের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মব সন্ত্রাস, নারী-শিশু নির্যাতন এবং সহিংসতার ঘটনায় দেশবাসী আতঙ্কিত। তারা সরকারের নীরবতা ও ব্যর্থতাকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে জনতা মারধর করেছিল। গত ৬ মে গুলশানে হেনস্তার শিকার হন ভাস্কর রাসা। ১৩ মে ঢাবির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্যকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়। সাম্প্রতিককালে মানসিক প্রতিবন্ধী শামীম হোসেনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে শোক ও উত্তেজনা।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলছেন, ‘দেশ আজ মব সন্ত্রাসের শিকার। এটি বন্ধ না হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।’ তারা সরকারের কাছে দাবি জানান, মব সন্ত্রাস বন্ধ করতে ত্বরিত ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মব সন্ত্রাসের উৎসগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক ঐক্য, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন এমন ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করে।
দেশ আজ এক কঠিন পরীক্ষা সামনে পেয়ে দাঁড়িয়ে যে, যেখানে মব সন্ত্রাস ও আইনশৃঙ্খলার শিথিলতা সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলাকে বিপন্ন করে তুলছে। দায়িত্বশীল সকলেই চাইছেন দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে সাধারণ মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করতে পারে এবং সমাজে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এভাবেই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ও সুসংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা না হলে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ