
ছবি: সংগৃহীত
গাজার রক্তাক্ত মাটি যেন অবশেষে একটুখানি আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলা ইসরাইলি বর্বর আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে অবশেষে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস একটি 'ইতিবাচক জবাব' দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার চার দিন পর শুক্রবার (৪ জুলাই) হামাসের এই প্রতিক্রিয়া যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের পথকে উন্মুক্ত করেছে বলে আশা করা হচ্ছে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, হামাস ইতিমধ্যে কাতার ও মিশরের মাধ্যমে তাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাঠিয়ে দিয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, তারা আলোচনায় অংশ নিতে প্রস্তুত। হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কাতার ও মিশরকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে আমাদের জবাব দিয়ে দিয়েছি। হামাসের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক। আমি মনে করি বিষয়টি চুক্তি অর্জনে সাহায্য করবে।”
এক বিবৃতিতে হামাস জানায়, “গাজায় আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সর্বশেষ প্রস্তাব সম্পর্কে হামাস নিজেদের মধ্যে পরামর্শ এবং ফিলিস্তিনি অন্যান্য দলের সাথে আলোচনা সম্পন্ন করেছে। ভ্রাতৃপ্রতিম মধ্যস্থতাকারীদেরকে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে হামাস তাদের ইতিবাচক জবাব দিয়েছে।”
হামাস আরও জানায়, তারা প্রস্তাবিত কাঠামোর আলোকে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। এটি এমন একটি মুহূর্তে এসেছে, যখন গাজা একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) হোয়াইট হাউসে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, “ইসরাইল এরইমধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো মেনে নিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যুদ্ধের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান বের করার চেষ্টা চলবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, হামাসের ‘ইতিবাচক জবাব’ ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়াবে—বিশেষ করে এখন, যখন গাজার ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানবিক সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
এই কূটনৈতিক আলোচনার আশার মধ্যেও গাজার বাস্তবতা ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হয়ে উঠছে। শুক্রবার ইসরাইলি বাহিনীর ড্রোন হামলায় গাজা সিটির আল-সাবরা গার্লস স্কুল এবং আল-হুররিয়া স্কুলে নিহত হয়েছেন অনেক বেসামরিক মানুষ। খান ইউনিস, জাবালিয়া এবং রাফায়ও প্রাণহানির খবর এসেছে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্যটি এসেছে রাফা থেকে, যেখানে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের (আইসিআরসি) ফিল্ড হাসপাতালের এক স্বাস্থ্যকর্মী।
রেড ক্রস জানায়, “এ ধরনের হামলা গাজার প্রতিদিনের বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার ৮৫ শতাংশ অঞ্চলকেই ইসরাইল ‘সামরিক এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। শুধু মার্চের পর থেকে নতুন করে গৃহহীন হয়েছেন ৭ লাখ ১৪ হাজার মানুষ। খাদ্য, পানি, ওষুধ তো দূরের কথা—চার মাস ধরে গাজায় এক ফোঁটা জ্বালানিও প্রবেশ করতে পারেনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, পুরো গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে গেছে। নাসের হাসপাতাল এখন আর চিকিৎসাকেন্দ্র নয়, বরং একটি বিশাল ট্রমা ওয়ার্ডে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালগুলোয় জেনারেটর চলে না, অস্ত্রোপচার হয় মোমবাতির আলোয়, আর অনেকক্ষেত্রে ডাক্তারদের নিজের হাতের আলোতে।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতেও নেই নিরাপত্তা। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের তথ্যে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থিত কনভয় এবং ত্রাণকেন্দ্রের আশপাশে ইসরাইলি হামলায় প্রাণ গেছে অন্তত ৬১৩ জনের, যাদের বেশিরভাগই শিশু ও তরুণ।
বিশ্বজুড়ে নেতারা, মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ গাজার জন্য একটি মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন। ইসরাইলি বাহিনীর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত উঠছে প্রতিবাদের ঝড়—কখনও জাতিসংঘের বৈঠকে, কখনও বিশ্ব মিডিয়ায়, আবার কখনও সাধারণ নাগরিকদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, রেড ক্রসসহ শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো একে একে গাজা পরিস্থিতিকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সমাধানের পথ যেন কেবল যুদ্ধ, রক্ত আর ধ্বংসের মধ্যেই বারবার হারিয়ে যাচ্ছে।
হামাসের ইতিবাচক সাড়া নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, তবে বাস্তবায়ন কতটা হবে—তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী, ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর। গাজার ২৩ লাখ মানুষের জীবন এখন ঝুলে আছে এই যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়নের ওপর। আলোচনার টেবিলে বসে যদি একটি কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান আসতে পারে, তাহলে তবেই হয়তো গাজার শিশুরা আর একটি বোমার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে কাঁদবে না।
এই যুদ্ধের অবসান চাই—তাত্ক্ষণিক, টেকসই এবং মানবিক মূল্যবোধের আলোকে। নতুবা গাজার মাটিতে রক্তের নদী বইতেই থাকবে, আর ট্র্যাজেডির নতুন নতুন অধ্যায় রচিত হতে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ