
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য চলমান আন্দোলন এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রতিবাদ করা এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন বন্দোবস্তের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। দুদকের অনুসন্ধান, বদলি, সাময়িক বহিষ্কার ও বাধ্যতামূলক অবসর – এই বাস্তবতায় তাদের মধ্যে বিরাজ করছে গভীর উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা। আন্দোলনের ভুল বুঝে নেওয়ার পর অনেকে ‘গণক্ষমা’ চাওয়া পর্যন্ত ভাবছেন।
গত কয়েক দিনে এনবিআরের অন্তত ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সময়ে ৬ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে, ৫ জনকে সাময়িক বহিষ্কার বা বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এতে কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ ফোন বন্ধ রেখে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছেন, আর অনেকেই নিজেদের কর্মসূচি থেকে দূরে সরে গেছেন। শীর্ষ কর্মকর্তা ও বড় বড় নেতাদের বিদায়ের খবরে মন ভেঙেছে অনেকের।
এক কর্মকর্তা জানালেন, “বাড়ি থেকে বোনকে ঢাকায় এনেছি, সব বুঝিয়ে বলেছি। চাকরি চলে গেলে কিংবা অনুসন্ধান শুরু হলে যেন বিচলিত না হয়। শুনেছি তালিকায় অন্তত ২৬ জন আছেন, যাদের সবাইকে বরখাস্ত করা হবে, আর ৫০ জনেরও শাস্তি আসছে।”
এনবিআরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মে মাসে যৌক্তিক সংস্কার ও এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে প্রথম দফায় আন্দোলন শুরু করেন। জুনের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় দফা আন্দোলন চলাকালীন সারাদেশের কাস্টম অফিস ও বন্দর একযোগে বন্ধ রাখা হয়। ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ নামে পরিচিত এই আন্দোলনকারী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন চলমান সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
তবে ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় ২৯ জুন আন্দোলন স্থগিত করা হয়। আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া দুদকের তদন্ত এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে শঙ্কায় পড়ে বেশিরভাগ কর্মী এখন ‘গণক্ষমা’ চাওয়ার চিন্তা করছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে অভিযোগ আনা হয়েছে যে, অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর ও শুল্ক আদায়ে ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ফলে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি, কেউ কেউ ঘুষ না পেয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে করদাতাদের হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, “এনবিআরের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। এটি কোনো সরকারের চাপ নয়, বরং অনুসন্ধান স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিয়মমাফিক।”
এনবিআরের এক মহাপরিচালক জানান, “আমি আন্দোলনে ছিলাম না, কিন্তু আন্দোলনের গ্রুপে যুক্ত করা হয়েছে। এখন খুবই টেনশনে আছি।” অন্য কেউ বলেন, “বদলির আদেশ ও দুদকের অনুসন্ধানের ভয়ে অনেকেই এখন বহিষ্কার হওয়াই ভালো মনে করছেন, কারণ পরে আপিলের মাধ্যমে চাকরি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”
এক সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা জানান, “আমাদের মতো দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তারা অবসর পাঠানো হয়েছে, এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা চিন্তায় পড়ে রয়েছি, কী করবো বুঝতে পারছি না।”
তবে দুদকের তদন্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখানোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন, “দুদকের তদন্ত করুক, কিন্তু আমাদের সামাজিক ইমেজ নষ্ট করার সুযোগ তারা পাবে না। শেষমেশ এনবিআরের ক্ষতি হবে।”
দুদকের অনুসন্ধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এনবিআরের সদস্য ও কমিশনারসহ অন্তত ১৬ কর্মকর্তা। তারা হলেন ঢাকা পূর্বের কমিশনার কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা সহ অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এর আগে ১ জুলাই আরও ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়।
২৮ ও ২৯ জুন ৬ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়, আন্দোলনের জের ধরে বলে ঐক্য পরিষদ দাবি করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় সরকারি নির্দেশনা অমান্যের অভিযোগে। এরপর এনবিআরের চার সদস্যকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও কর নীতি বিশেষজ্ঞ ড. সুমন চন্দ্র রায় বলেন, “এনবিআরের সংস্কার অপরিহার্য, কিন্তু আন্দোলনের পদ্ধতি এবং সময় নির্বাচনে ভুল হয়েছে। দুর্নীতি দমন প্রয়োজন, কিন্তু এই পর্যায়ে শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।”
সরকারি প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. ফারহানা জাহান মন্তব্য করেন, “রাজস্ব সঙ্কট দেশের অর্থনীতির ব্লাডলাইন; এখানে আন্দোলনকারীদের দায়িত্বশীলতা এবং সরকারি নীতিনির্ভর ব্যবস্থা জরুরি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি জরুরি হলেও, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও রাখতে হবে।”
বাণিজ্য ও শিল্প সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, “এনবিআর দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, তবে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনার সময় কর্মীদের নিরাপত্তা ও ন্যায়নিষ্ঠা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।”
অপরদিকে আন্দোলনের নেতারা এনবিআর চেয়ারম্যানকে দায়ী করে বলেন, “তিনি লংকৃতিতে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, যার ফলে পরিস্থিতি এমন অবনতিতে পৌঁছেছে।”
আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর ৩০ জুন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, “আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটেছে। এখন ভুলগুলো ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।”
তবে এরপর থেকে তিনি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থেকে দূরে থাকছেন। গত ৩ জুলাই ঢাকার কাস্টম হাউজ পরিদর্শনের সময়ও অনিবার্য কারণে উপস্থিত হতে পারেননি।
২০১৫ সালের পর দীর্ঘদিন পর চলা এই এনবিআর আন্দোলন এবং এর প্রভাব দেশের কর ও শুল্ক আদায় ব্যবস্থায় স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে। দুদকের তৎপরতা এবং সরকারী শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রভাবে এখন কর্মীদের মধ্যে সংশয়, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। অনেকেই এখন ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত, আবার কেউ কেউ মনে করছেন ব্যবস্থা কঠোর হলেও এর মোকাবিলা করা সম্ভব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এনবিআরের সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কার্যক্রম যেন দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করে তুলতে পারে। অন্যথায় এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি কর্মীদের মনোবল বাড়ানো, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক দখলদারিত্ব দূরীকরণ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
এই অবস্থা যেন এনবিআরের জন্য শুধু একটি সংকট নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় পরীক্ষা। সময় এসেছে সকলে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মিলিত হয়ে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার। নইলে ‘গলার কাঁটা’ এই আন্দোলন ও তার পরিণতি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের জন্য গভীর সংকেত হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এসজে