
ছবি: সংগৃহীত
এক সময়ের জনপ্রিয় তারকা দম্পতি তাহসান খান ও রাফিয়াত রশিদ মিথিলা—যাদের প্রেম শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। নাটক-গান-পারিবারিক আবহে তারা ছিলেন দেশের ‘আদর্শ জুটি’র প্রতীক। ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট এই দুই তারকা জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেন—বিয়ে করেন ভালোবাসার মানুষকে। ২০১৩ সালে জন্ম নেয় তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান আইরা তাহরিম খান, যা তাদের পারিবারিক জীবনে যোগ করেছিল নতুন মাত্রা। কিন্তু সেই প্রেমের গল্প থেমে যায় ২০১৭ সালের মে মাসে, যখন তাদের বিচ্ছেদের খবর দেশের বিনোদন জগতে ও ভক্তদের মধ্যে সৃষ্টি করে আলোড়ন ও হতাশা।
এই বিচ্ছেদের আট বছর পর অবশেষে মুখ খুলেছেন মিথিলা। সাম্প্রতিক এক পডকাস্ট অনুষ্ঠানে নিজের জীবনের গভীরতম অনুভূতি ও মানসিক টানাপোড়েনের কথা অকপটে জানিয়েছেন এই অভিনেত্রী, যিনি বর্তমানে একজন আন্তর্জাতিক উন্নয়নকর্মী, অভিনেত্রী এবং লেখিকা হিসেবে সফল ক্যারিয়ার গড়েছেন।
‘আমি তখন অল্পবয়সী তরুণী মা, নিজের সিদ্ধান্তে আসার শক্তি ছিল না’
পডকাস্টে নিজের বিচ্ছেদ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মিথিলা। বলেন, “তখন আমি অনেক অল্পবয়সী ছিলাম। সদ্য মা হয়েছি, মানসিক অবস্থাও ভালো ছিল না। যেকোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া খুব সহজ বিষয় না। সেটা বন্ধু হোক, স্বামী হোক কিংবা অন্য কেউ। কিন্তু আমার জীবনের তখনকার পরিস্থিতিতে আমি ভালো-মন্দ বিচার করার জায়গায় ছিলাম না। আমার একটা এক বছরের বাচ্চা ছিল, আমি চাইলেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।”
মিথিলা জানান, বিচ্ছেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগেও তারা প্রায় দুই বছর আলাদা ছিলেন। সেই সময়টাকে তিনি বললেন ‘ঝুলন্ত সময়’। তার ভাষায়, “সেই সময়টা ছিল অনেক জটিল। আমি ভাবতাম, হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো আমাদের বিচ্ছেদ হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।”
হঠাৎ বদলে যাওয়া জীবন, অনিশ্চয়তা আর শূন্যতা
নিজের জীবনের বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে মিথিলা জানান, “২৩ বছর বয়স থেকে আমি আমার জীবনকে একভাবে ভেবে এসেছিলাম। পরিকল্পনা করেছিলাম, পরিবার থাকবে, সন্তান থাকবে, সংসার থাকবে। কিন্তু সেই জীবনের পরিকল্পনা হঠাৎ করে ভেঙে গেল। আমি তখন জানলাম, আমার শ্বশুরবাড়ি আর আমার ভবিষ্যত নয়। আমি চাকরি করতাম, কিন্তু আমার নিজের কোনো গাড়ি ছিল না। অথচ আমার ও আমার সন্তানের অভ্যাস ছিল গাড়িতে চলাফেরা করার।”
তিনি আরও বলেন, “আমি আমার শ্বশুরবাড়ির মানুষের সঙ্গে থেকেছি। সবকিছু ছিল মিলেমিশে। সেই জায়গা হঠাৎ করে যখন আমার জন্য নিরাপদ বা স্থায়ী জায়গা রইল না, তখন আমাকে ভিন্ন বাস্তবতায় মানিয়ে নিতে হয়েছে। বাবার বাড়ি ছিল, কিন্তু সেটা কি আমার জায়গা? না। সেই জায়গা থেকে বুঝতে শিখেছি, নারীদের নিজেদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা কতটা জরুরি।”
‘মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন’
মিথিলা তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “মেয়েদের আসলে নিজেদের জায়গা বলতে কিছু থাকে না। একটা মেয়ে বাবার বাড়িতে থাকে, তারপর যায় স্বামীর বাড়িতে। দুটোই ভাড়া জায়গা। থ্যাঙ্কফুলি এখন আমার নিজের একটা জায়গা হয়েছে। নিজের রোজগার আছে, নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা এসেছে। আমি এখন বুঝি, জীবনের যেকোনো কঠিন সময়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকলে আপনি নিজেকে ধরে রাখতে পারবেন না।”
তিনি আরও বলেন, “যে কোনো সম্পর্ক ভাঙা মানে শুধু একজন মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের সমাপ্তি নয়, বরং এটা একটা সামাজিক কাঠামোর, একটা জীবনের রূপরেখার ভেঙে পড়া। একজন নারী হিসেবে আমার যখন মানসিক ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থা ছিল, তখন আমি অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। এখন বুঝি, তখন অনেক ভুল করেছি, অনেক কিছু ভুলভাবে দেখেছি।”
‘তাহসান ছিলেন তখনও আমার পরিচিত সবচেয়ে আপন মানুষ’
সাক্ষাৎকারে মিথিলা জানান, তাহসানের সঙ্গে সম্পর্কের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সময়টা ছিল আবেগের, ভালোবাসার এবং জটিলতার মিশেল। “সেপারেশনের সময় আমার মধ্যে একটা আশা ছিল—সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তাহসান তখনও আমার সবচেয়ে আপন মানুষ। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। ধীরে ধীরে বুঝেছি, মানুষ হিসেবে আমরা হয়তো আলাদা হয়ে গিয়েছি।”
বিচ্ছেদের পর নতুন করে পথচলা, জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া
বিচ্ছেদের পর মিথিলা থেমে থাকেননি। নিজের মেয়েকে মানুষ করার পাশাপাশি ক্যারিয়ার গড়েছেন। কাজ করেছেন দেশি-বিদেশি উন্নয়ন সংস্থায়, নাটক-ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছেন, শিশুদের জন্য বই লিখেছেন। ২০১৯ সালে কলকাতার খ্যাতিমান পরিচালক সৃজিত মুখার্জিকে বিয়ে করে জীবন শুরু করেন নতুনভাবে।
তবে এই সাক্ষাৎকারে মিথিলা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তাহসানের সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে অস্থির ও অনিশ্চিত সময় ছিল। সেই সময়ে তিনি বুঝতে শিখেছেন, একজন নারীর জীবনে আত্মপরিচয়, আর্থিক স্বনির্ভরতা এবং মানসিক দৃঢ়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
‘আত্মোপলব্ধি অনেক সময় পরে আসে’
সবশেষে মিথিলা বলেন, “জীবনের কিছু সিদ্ধান্তের ফল আমরা অনেক পরে বুঝি। সেই সময়টায় হয়তো আবেগপ্রবণ ছিলাম, পরিস্থিতির চাপে ছিলাম। কিন্তু আজ যখন ফিরে দেখি, তখন বুঝতে পারি—আমার অনেক কিছুই তখন বোঝার মতো পরিপক্বতা ছিল না। এখন আমি চেষ্টা করি, আমার মেয়েকে এমনভাবে বড় করতে যেন সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, নিজের জায়গা তৈরি করতে পারে।”
বিচ্ছেদের আট বছর পর মিথিলার এই অকপট স্বীকারোক্তি যেন নতুন করে নারীর স্বাধীনতা, আত্মপরিচয় এবং সম্পর্কের বাস্তবতা নিয়ে সমাজে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে। একজন তারকার জীবনের অন্তরালের কাহিনি যেমন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করায়, তেমনি অনেক নারীর জীবনের প্রতিচ্ছবিও হয়ে ওঠে। মিথিলার মতো আরও অনেকেই হয়তো তাদের ভাঙনের গল্প বলতে পারছেন না, কিন্তু এই স্বীকারোক্তি হয়তো অনেককে সাহস জোগাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ