
ছবি: সংগৃহীত
দেশের চালের বাজার বর্তমানে এক অদ্ভুত অস্থিরতার মুখোমুখি, যেন পাগলা ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাম উর্ধ্বগামী পথে ছুটছে। চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনও ঘাটতি নেই। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চালের মজুতও বাড়ার পরেও কেন বাজারে এই উত্থান-পতন, তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় খুঁজছে সমাধানের পথ। এই পরিস্থিতি নিয়ে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যার ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধনের মাধ্যমে চালের দাম সহনীয় রাখার দাবি তোলা হয়েছে।
গত কয়েক বছরে তীব্র মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে বাঁচতে পেরে মানুষ সামান্য স্বস্তি পেতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে শীত মৌসুম থেকে শুরু করে বিভিন্ন তাজা খাদ্যপণ্যের দাম কমার ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই চালের বাজারে অস্থিরতা আবার উদ্বেগের সংকেত জাগাচ্ছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, এভাবে দাম বাড়তে থাকলে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি পুনরায় জোরালো হবে, যা ক্রমশ দুর্বল অর্থনীতির উপর নেমে আসতে পারে।
চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, “করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আগাম টাকা দিয়ে ধান কেনার কারণে মিল মালিকরা প্রয়োজনীয় পরিমাণ ধান পাচ্ছেন না। ধান কম পাওয়ায় চাল উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা বাজারে দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আউশ ও আমনের উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার টন কম হয়েছে। আউশ ধানের উৎপাদন ৬ শতাংশ কমে গিয়েছে। যদিও বোরো মৌসুমের উৎপাদন চূড়ান্ত হয়নি, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী বোরো মৌসুমে উৎপাদন কমতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি মজুতের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে দেশের গুদামে চাল ও গমের মজুত রয়েছে ১৭.৬৪ লাখ টন, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। এর মধ্যে চালের মজুত ১০.৬০ লাখ এবং গমের ৪.১৩ লাখ টন। তারপরও বাজার স্থিতিশীল নয়।
বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি কাওসার আজম বাবু জানান, “কোরবানির ঈদ উপলক্ষে প্রায় ১৫ দিন সবকিছু বন্ধ থাকার প্রভাবে বাজারে সাময়িক দাম বৃদ্ধি দেখা গেছে। আশা করা যাচ্ছে, কয়েক দিনের মধ্যেই বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।”
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলছেন, “উৎপাদন ভালো হলেও বাজারের দাম কমার পরিবর্তে বাড়ছে। এর পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। তারা নীতিমালা উপেক্ষা করে চাল মজুত করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।”
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন মন্তব্য করেন, “ধান-চালের বাজারে পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব রয়েছে এবং প্রশাসনের ভূমিকা দুর্বল। এই পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।”
চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার চালকল মালিক, পাইকার ও আড়তদাররা জানান, করপোরেট কোম্পানিগুলো চাল ওঠার আগেই দাম পরিশোধ করছে। এ কারণে পুরনো নিয়মে ধান পাওয়া কমছে, যার প্রভাব বাজারে পড়ছে।
সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, মাত্র এক মাসে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে প্রায় ৭ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, আর এক বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ টাকা। পাইকারি বাজারে ৫০ কেজির বস্তার দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা, যা খুচরা বাজারেও প্রভাব ফেলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা।
চালের পাশাপাশি সবজি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী। রাজধানীর বাজারে ঝিঙে, বেগুন, বরবটি, করলা, ঢ্যাঁড়শসহ বেশ কিছু সবজির দাম ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মাছ ও প্রোটিনজাতীয় পণ্যের বাজারে সামান্য স্থিতিশীলতা রয়েছে। তবে কিছু মসলা ও ডালের দাম সামান্য কমায় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেছে।
রিকশা চালক আনিসুর রহমান জানান, “সারা দিন কাজ করে আয় হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য কেনায় পুরো টাকা চলে যাচ্ছে। এভাবে চলতে পারছি না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি পর্যায়ে চাল ও ধানের বাজারে কার্যকর নজরদারি এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব নয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য বিভাগকে দ্রুত এ বিষয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে যাতে দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্যের সংকটে না পড়ে।
চালের বাজারে এই অস্থিরতা অর্থনীতির জন্য বড় সংকেত। দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ সংকট না থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্র, করপোরেট কোম্পানির অগ্রিম ক্রয় এবং নজরদারির অভাবে বাজারে চাহিদা-সরবরাহ ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনা হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে এবং মূল্যস্ফীতি আবারো তীব্র আকার নিতে পারে।
সরকার, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করে চালের বাজারের স্থিতিশীলতা ফেরাতে হবে, যেন দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ