
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের প্রশাসন কাঠামোতে একাধিক স্তরে ভয়াবহ শূন্যতা এবং পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে তীব্র অসন্তোষ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। একদিকে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদগুলো শূন্য পড়ে আছে, অন্যদিকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একাধিক ব্যাচের কর্মকর্তারা বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় থেকে এখন হতাশা ও ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। এতে করে প্রশাসনের অভ্যন্তরে ‘চাপা উত্তেজনা’ তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সচিব ও মহাপরিচালকের একাধিক পদ শূন্য, চলছে ভারপ্রাপ্তদের ওপর নির্ভরতা
বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে সচিব বা সচিব পদমর্যাদার অন্তত ৯টি পদ শূন্য রয়েছে। বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব), জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব, বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব), জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (সচিব), জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির রেক্টর (সচিব) এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান (গ্রেড-১) পদে কোনো কর্মকর্তাই নেই।
এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কাজ চলছে কেবল ভারপ্রাপ্ত সচিবদের দিয়ে, যা অনেকক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রশাসনিক গতি নিশ্চিত করতে পারছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সচিব ও সচিব পদমর্যাদার মোট অনুমোদিত পদ ৭৮টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৬৯ জন, বাকিগুলো শূন্য।
অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে ভয়াবহ সংকট: ২২৮টি পদ শূন্য
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ ৫৯২টি হলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৩৪৪ জন। অর্থাৎ ২২৮টি অতিরিক্ত সচিবের পদ শূন্য রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরও অন্তত ১৫০ জন অবসরে যাবেন বলে জানা গেছে। ফলে তখন এ সংখ্যা নেমে দাঁড়াবে মাত্র ১৯৪ জনে, যা কার্যত প্রশাসনের শীর্ষ কাঠামোকে ভেঙে দেওয়ার শামিল।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়সহ অন্তত এক ডজন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অতিরিক্ত সচিব প্রশাসন পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে নবসৃষ্ট অতিরিক্ত সচিব পদেও কেউ নেই। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেও (বিডা) মহাপরিচালকের পদ খালি পড়ে আছে।
যুগ্মসচিব ও উপসচিব স্তরেও ঘাটতি
যুগ্মসচিবের অনুমোদিত পদ রয়েছে ১ হাজার ১৫৫টি, অথচ কর্মরত আছেন ১ হাজার ৩৮ জন। শূন্য পদ ১১৭টি। উপসচিব পর্যায়ে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ২ হাজার ৫০০টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন। অর্থাৎ শূন্য রয়েছে এক হাজার পদ।
এই সংকট নিরসনে বিএএসএ দ্রুত পদোন্নতির দাবি জানালেও সরকার এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ সংগঠনটির নেতাদের।
ঝুলে থাকা পদোন্নতি: ২০তম, ২৪তম ও ৩০তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চরম অসন্তোষ
সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ জমেছে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে। দীর্ঘদিন ধরে ২০তম ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি ঝুলে রয়েছে। এ নিয়ে বহুবার আলোচনার পরও কোনো সমাধান আসেনি।
অন্যদিকে, ২৪তম বিসিএস ক্যাডারের পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের রিভিউ এক মাসের মধ্যে করার আশ্বাস দেওয়া হলেও সেটিও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। তাদের একাংশ মনে করছেন, রাজনৈতিক অথবা প্রভাবশালী মহলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কারণে এ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়া ৩০তম বিসিএসের কর্মকর্তারা দেড় বছর ধরে উপসচিব পদে পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন। অথচ এই ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা ইতোমধ্যেই পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।
একসঙ্গে পদোন্নতি না দেওয়া নিয়ে দ্বিমত
২১তম ও ২২তম বিসিএস প্রশাসন ব্যাচকে একসঙ্গে পদোন্নতির বিষয়েও ভিন্নমত রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। কেউ কেউ বলছেন, একই বছরে দুই ব্যাচের পদোন্নতি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু একসঙ্গে নয়—ছয় মাস আগে-পরে হতে পারে। এই অবস্থানও হতাশা বাড়াচ্ছে ক্যাডারের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
‘প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের দোসরদের অবস্থান’ নিয়ে ক্ষোভ
বিএএসএ’র মহাসচিব মো. শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী অভিযোগ করেন, “প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বৈরাচার আমলে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের এখনও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। বরং কিছু ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বহাল তবিয়তে রয়েছেন, যারা পদোন্নতি প্রক্রিয়াকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছেন।”
তিনি আরও জানান, এসব বিষয় তারা জনপ্রশাসন সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখনও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, “বিএএসএ নেতারা এসেছিলেন। আন্তরিক পরিবেশে আমরা তাদের কথা শুনেছি। তাদের বক্তব্য সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের। আমরা চেষ্টা করছি। তবে সময় লাগবে।”
চাপা উত্তেজনা, কাঠামোগত ব্যর্থতা
প্রশাসনের অভ্যন্তরে কর্মকর্তাদের মধ্যে এখন এক ধরনের নীরব চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। বছরের পর বছর চাকরিজীবনে সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও যদি রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা অদৃশ্য প্রভাবের কারণে পদোন্নতি ঝুলে থাকে, তবে তা প্রশাসনের মনোবল ও দক্ষতা—দুটিকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।
অবশ্যই সময় এসেছে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং নীতিনির্ধারকহীন পদোন্নতি ও পদায়ন প্রক্রিয়া চালু করার। প্রশাসনের শীর্ষ থেকে নিচ পর্যন্ত কাঠামোগত শূন্যতা দূর না হলে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা কঠিনই নয়—প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ প্রশাসন যদি দুর্বল থাকে, রাষ্ট্র চলবে কিভাবে?
সরকারের উচিত হবে দ্রুত পদোন্নতির জট খুলে যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পদায়নের মাধ্যমে প্রশাসনে কাঙ্ক্ষিত গতি ও আস্থা ফিরিয়ে আনা। নইলে এই অচলাবস্থা দীর্ঘমেয়াদে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বাংলাবার্তা/এসজে