
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির উদ্যোগ ঘিরে রাজস্ব প্রশাসনে সৃষ্টি হয়েছে অভূতপূর্ব অস্থিরতা ও প্রতিক্রিয়া। আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের তীব্র আপত্তির মধ্যেই প্রক্রিয়া শেষের দিকে একটি খসড়া অধ্যাদেশের ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে। তবে এনবিআর সংস্কারের নামে তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন—আসলে এটি রাষ্ট্রের স্বার্থে, না কি বিশেষ গোষ্ঠীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটি প্রক্রিয়া?
জানা গেছে, এনবিআর বিলুপ্ত করে আয়কর ও কাস্টমস বিভাগকে আলাদা করে দুটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের লক্ষ্যে খসড়া অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়েছে এবং আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং প্রক্রিয়াও শেষ হয়ে গেছে। অথচ সংশ্লিষ্টদের মতে, বিষয়টি এতটাই গোপনীয়ভাবে করা হয়েছে যে এনবিআরের ভেতরে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আগে কিছু জানতেন না। তাদের কারও মতামত নেওয়া হয়নি, এমনকি বিষয়টি নিয়ে কোনো সমীক্ষাও চালানো হয়নি।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "যেখানে বিশ্বজুড়ে রাজস্ব বোর্ডগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। এনবিআরকে শক্তিশালী না করে একে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া মানে হলো রাজস্ব ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলা।"
কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডারের বহু কর্মকর্তা মনে করছেন, এনবিআর বিলুপ্তির পেছনে অন্যতম বড় উদ্দেশ্য হলো প্রশাসনের একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারকে উচ্চপদে বসানো। বর্তমানে এনবিআরের প্রধান হিসেবে একজন সিনিয়র কাস্টমস বা আয়কর কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু পৃথক বিভাগ করে আরও একটি চিফ পদের সৃষ্টির মাধ্যমে বাইরের এক ক্যাডারকে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেই মনে করেন অনেকে।
তাদের ভাষ্য, এ উদ্যোগের ফলে বিদ্যমান অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের অবমূল্যায়ন হবে এবং মাঠ পর্যায়ে যে রাজস্ব আহরণের দক্ষ কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সেটিও ভেঙে পড়বে।
একজন কাস্টমস কমিশনার বলেন, "সংস্কারের কথা বলে এনবিআরের আত্মা ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রবিরোধী সিদ্ধান্ত আর কী হতে পারে?"
খসড়া অধ্যাদেশ ফাঁস হওয়ার পরপরই এনবিআরের কাস্টমস ও আয়কর দুই ক্যাডারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা দাবি করেন, এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এরই মধ্যে দুটি ক্যাডার থেকে একটি যৌথ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে আলাপ-আলোচনা করছেন।
গত বৃহস্পতিবার কিছু কর্মকর্তা এনবিআরের পরামর্শক কমিটির প্রধান ও সাবেক সচিব আব্দুল মজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি তার দৃষ্টিগোচর করেন। তবে সাবেক এই আমলা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজস্ব ভবনে প্রতিদিনই জড়ো হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আজ সোমবার (১২ মে) এনবিআরের মূল ভবনে এক অনানুষ্ঠানিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন শতাধিক কর্মকর্তা। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের অবস্থান সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে চান।
যখন খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে, ঠিক তখনই এনবিআরের ভেতর থেকে কয়েকজন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, আয়কর ক্যাডার থেকে দুইজন এবং কাস্টমস ক্যাডার থেকে চারজন কর্মকর্তার পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। আন্দোলন থামাতে এই পদোন্নতির প্রস্তাবকে একধরনের ‘চোখে ধুলা’ বলেই দেখছেন আন্দোলনরত কর্মকর্তারা।
তাদের ভাষায়, এটি স্পষ্টভাবে একটি কৌশল, যাতে ভেতরের বিভাজন বাড়িয়ে পুরো প্রতিরোধ দুর্বল করে ফেলা যায়।
প্রশাসনিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নুরুল আমিন মনে করেন, “এনবিআর একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠান, যার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ডেটা কাঠামো ও মানবসম্পদ গড়ে উঠেছে বহু দশকের চেষ্টায়। এটিকে হঠাৎ বিলুপ্ত করা মানে সেই কাঠামোকে ধ্বংস করা। সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু তা হতে হবে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে, তথ্যভিত্তিক ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে।”
অপরদিকে, রাজস্ব প্রশাসনের সাবেক একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “এটা আসলে এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল গেম’। কিছু মানুষ চায় রাজস্ব খাতেও রাজনৈতিক অনুগতদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে। এনবিআর বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে সেই পথটা পরিষ্কার করা হচ্ছে।”
এনবিআর কর্মরত কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই খসড়া অধ্যাদেশ কার্যকর হলে রাজস্ব আদায়ের মূল কাঠামো ভেঙে পড়বে। কারণ, এনবিআরের অধীনে কর, ভ্যাট ও কাস্টমসের মধ্যে একটি সমন্বয় ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ রয়েছে। একে দুই বা ততোধিক সংস্থায় ভাগ করলে ব্যবস্থাপনায় দ্বন্দ্ব, দায়িত্বজট এবং ফাঁকফোকর বেড়ে যাবে। এতে রাজস্ব আহরণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং সরকারের আয় হ্রাস পাবে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
যেখানে বিশ্বের বহু দেশ রাজস্ব খাতকে ডিজিটালাইজড ও ইন্টিগ্রেটেড করার পথে এগোচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এনবিআরের মতো একটি সফল ও প্রমাণিত সংস্থাকে বিলুপ্ত করে বিভাজনের পথে হাঁটছে সরকার। এ সিদ্ধান্ত শুধু মাত্র প্রশাসনিক নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এনবিআরের ভবিষ্যৎ এখন আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের কণ্ঠে, জনগণের প্রতিক্রিয়ায় এবং নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায়। প্রশ্ন উঠেছে—এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের কল্যাণে, নাকি ক্ষমতার ভারসাম্যে অদৃশ্য কিছু হাতের খেলা?
বাংলাবার্তা/এসজে