
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও) এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তারা (এআরও) বর্তমানে একটি গভীর পেশাগত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, যার মূলে রয়েছে পদবির পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তারা তাদের পূর্বের, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং বহুল ব্যবহৃত পদবি ‘ইন্সপেক্টর’ ও ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ পুনর্বহালের দাবি তুলেছেন। এই দাবির পেছনে রয়েছে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশে পরিচয় সংকটের বাস্তবতা, যা পেশাগত কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলে অভিযোগ তাদের।
রোববার (৪ মে) দুপুরে বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাকাএভ) শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের কাছে লিখিতভাবে তাদের এই দাবি উত্থাপন করেন। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি কে এম মাহবুব আলম এবং মহাসচিব তানভীর আহমেদ। এ সময় এনবিআরের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মাঠপর্যায়ে দেশি-বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কাজ করার সময় বর্তমান পদবিগুলো পরিচয়ের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিদেশি কর্তৃপক্ষ ও পেশাজীবীরা ‘ইন্সপেক্টর’ বা ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ পদবি চেনেন এবং এদের সঙ্গে কাজ করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু ‘সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা’ বা ‘রাজস্ব কর্মকর্তা’ বললে তারা সেই গুরুত্ব বা প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করতে পারছেন না। এতে অনেক সময় কাজের গতি ব্যাহত হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মানসিক ও পেশাগতভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
বাকাএভ সভাপতি কে এম মাহবুব আলম বলেন, "আমরা দেখছি, মাঠপর্যায়ে বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের পাইলট, বিদেশি কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বা সীমান্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে পরিচয়ের জায়গায় বারবার সমস্যা হচ্ছে। তারা 'ইন্সপেক্টর' বা 'সুপারিনটেনডেন্ট' বুঝতে পারেন, কিন্তু ‘এআরও’ বা ‘আরও’ শুনে বিভ্রান্ত হন। এটা শুধু সম্মানের বিষয় নয়, কার্যকারিতার বিষয়ও। অনেক সময় পরিচয় বোঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়, আর তা পুরো প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে।”
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশের কাস্টমস বিভাগে ‘ইন্সপেক্টর’ ও ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ পদবিগুলো এখনও বহাল রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচল ও বিমানবন্দরের কার্যক্রমে এই নামেই পরিচিতি বহাল। ফলে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বঞ্চিত হচ্ছেন সমান মর্যাদা ও সুবিধা থেকে।
তারা আরও বলেন, সমস্যা শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। দেশীয় পর্যায়েও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। কারণ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘রাজস্ব কর্মকর্তা’ বা ‘সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা’ নামে আরও অনেক পদ রয়েছে, যেগুলোর কাজ বা কর্তৃত্বের পরিধি একেবারে ভিন্ন। ফলে এনবিআরের কর্মকর্তারা পরিচয়ের দিক থেকে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝাতে গিয়েও জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘ইন্সপেক্টর’ ও ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ পদবি কাস্টমস বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় বহন করে। এটি শুধু একটি নাম নয়, এটি একটি প্রতিষ্ঠিত পরিচয়, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে পেশাদারিত্ব, নির্ভরযোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সামর্থ্য। আর এই পদবিগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কোনো বাড়তি ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
২০১০-১১ অর্থবছরে এনবিআর একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘ইন্সপেক্টর’ ও ‘সুপারিনটেনডেন্ট’ পদবির পরিবর্তন করে যথাক্রমে ‘সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও)’ ও ‘রাজস্ব কর্মকর্তা (আরও)’ পদবি চালু করে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে মূলত পদবির আধুনিকীকরণ এবং প্রশাসনিক শ্রেণিবিন্যাসের একটি অভ্যন্তরীণ প্রয়াস ছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে দেখা যাচ্ছে, এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
অর্থনীতি ও জনপ্রশাসন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনবিআরের কর্মকর্তাদের এই দাবি যৌক্তিক। পদবি শুধুই আনুষ্ঠানিক বিষয় নয়, বরং তা পেশাগত পরিচয়ের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পরিচয়ের এই সংকট নিরসনে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক প্রশাসন শিক্ষক বলেন, “আমাদের উচিত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নিজেদের কাঠামোকে সংহত করা। যেখানে পরিচয়ের সুষ্পষ্টতা একটি কার্যকর প্রশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত, সেখানে যদি আমাদের কর্মকর্তারাই পরিচয় দিতে গিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হন, তবে এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোরই দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।”
এনবিআরের কর্মকর্তারা শুধু একটি পদবি নয়, তারা তাদের পেশাগত মর্যাদা, কার্যকারিতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুবিধার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দাবি তুলেছেন। বিষয়টি এনবিআরের উচ্চপর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন দেখার বিষয় সরকার এ ব্যাপারে কতটা দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়। পদবির এই সংকট দীর্ঘ হলে তা শুধু কর্মকর্তাদের নয়, দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকেই প্রভাবিত করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে