
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর টানা সামরিক অভিযান আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) থেকে শুক্রবার (৪ জুলাই) পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৩৮ জন ফিলিস্তিনি। একই সময়ে আহত হয়েছেন আরও ৬২৫ জন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুক্রবার সন্ধ্যায় দেওয়া এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি এই খবর প্রকাশ করেছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ দুই দিনের হামলায় নিহতদের মধ্যে বহু নারী ও শিশুও রয়েছে। আহতদের বেশিরভাগের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানানো হয়েছে। অনেককেই গাজার বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি করা হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং জনবল সংকটে অনেকের চিকিৎসা বিঘ্নিত হচ্ছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-হামাস সংঘাতের পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরাইলি অভিযানে গাজা উপত্যকায় মোট নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ২৬৮ জনে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৭৩ জন। এদের বড় একটি অংশই বেসামরিক মানুষ, যার মধ্যে শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা অত্যন্ত বেশি।
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। কারণ গাজার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে অসংখ্য মানুষ চাপা পড়ে আছেন। উদ্ধার তৎপরতা চালাতে গিয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে টানা বোমাবর্ষণ, অবকাঠামোগত ধ্বংস এবং সীমিত মানবিক সহায়তা।
গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরাইলের দক্ষিণাঞ্চলে অভূতপূর্ব এক হামলা চালায়। হামলায় ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী, হামাস ১২০০ ইসরাইলিকে হত্যা করে এবং আরও ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এই ঘটনার পরপরই জবাবি হামলা চালায় ইসরাইলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। শুরু হয় এক অঘোষিত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ।
এই যুদ্ধের প্রথম দফায় প্রায় ৪ মাস ধরে গাজায় চালানো হয় তীব্র বিমান হামলা, ট্যাংক হামলা এবং স্থল অভিযান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর সমালোচনা ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশের মধ্যস্থতার চাপে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে ইসরাইল।
তবে সেই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হয়নি। মাত্র দুই মাসের মাথায়, গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইল ফের গাজায় আক্রমণ শুরু করে। দ্বিতীয় দফার এ অভিযানে ইতোমধ্যে নিহত হয়েছেন আরও ৬ হাজার ৭১০ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন প্রায় ২৩ হাজার ৫৮৪ জন। বিশেষ করে দক্ষিণ গাজার রাফা, খান ইউনিস এবং মধ্য গাজার শহরগুলোয় হামলার মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এই অভিযানে ইসরাইলি বাহিনী টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করছে স্কুল, হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র, মসজিদসহ জনবহুল আবাসিক ভবনগুলোকে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার বলছে, এই ধরণের হামলা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের আওতাভুক্ত হতে পারে। অথচ ইসরাইলের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা ‘হামাসের জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তু করছে’।
হামাসের হাতে নেওয়া ২৫১ জন ইসরাইলি জিম্মির মধ্যে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে মুক্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায়। তবে গাজায় ইসরাইলি অভিযানে বেশ কয়েকজন জিম্মি নিহত হয়েছেন বলেও দাবি করেছে হামাস। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এখনও অন্তত ৩৫ জন জিম্মি জীবিত রয়েছেন এবং তাদের উদ্ধারের জন্য ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানো হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে আইডিএফ।
এদিকে, যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকায় গাজার মানবিক সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বেঁচে থাকাটাই গাজার মানুষদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার তরফ থেকে বলা হচ্ছে, গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
ইসরাইলের এসব হামলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘের বিভিন্ন দপ্তর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পুনরায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “গাজায় আর কোনো প্রাণহানি সহ্য করা সম্ভব নয়। এখনই অস্ত্র নীরব করতে হবে।”
তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বারবার বলেছেন, “জিম্মি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত গাজায় অভিযান চলবে।” অপরদিকে হামাস বলেছে, “তারা শুধু আত্মরক্ষার্থেই যুদ্ধ করছে এবং যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত হিসেবে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও অবরোধ তুলে নেওয়ার দাবি অব্যাহত থাকবে।”
এই সংঘাত কবে থামবে, কত প্রাণ হারাবে আর কত ঘরবাড়ি ধ্বংস হবে—তার উত্তর এখনও অনিশ্চিত। তবে এতটুকু স্পষ্ট, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় প্রতিটি দিনই বয়ে আনছে নতুন মৃত্যুর মিছিল, আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ