
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে কাস্টমস শুল্ক আদায়ে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন শুরু হচ্ছে। দেশের সকল কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনে আমদানি-রপ্তানির শুল্ককর ‘এ-চালান’ বা ইলেকট্রনিক চালান পদ্ধতির মাধ্যমে অনলাইনে জমা দেওয়া যাবে। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে করদাতারা ঘরে বসেই বিভিন্ন ডিজিটাল মাধ্যমে শুল্ক পরিশোধ করে পণ্য দ্রুততম সময়ে খালাস করতে পারবে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এই পরিবর্তন সুশৃঙ্খলতা, স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের ৩ আগস্ট দেশের সবচেয়ে বড় কাস্টম হাউস হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ‘এ-চালান’ পদ্ধতির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে ২৩ এপ্রিল আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউসে এবং পরবর্তীতে পানগাঁও কাস্টম হাউসে সফলভাবে এ পদ্ধতি চালু হয়। চট্টগ্রামের এই সফল সূচনা পরবর্তীতে দেশের বাকি সকল কাস্টম হাউসেও ৭ জুলাই থেকে ‘এ-চালান’ পদ্ধতি কার্যকর করা হবে। এতে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও সংশ্লিষ্টরা তাদের দায়িত্বরত শুল্ক কর সহজ, দ্রুত ও নিরাপদে জমা দিতে পারবেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ বিভাগের আইভাস প্লাস প্লাস স্কিমের ‘এ-চালান’ সিস্টেমের মধ্যে সফল ইন্টিগ্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। এই সমন্বয়ের মাধ্যমে ‘এ-চালান’ পদ্ধতিতে জমা দেয়া অর্থ সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি সরকারি ট্রেজারিতে পৌঁছায়। ফলে শুল্ক আদায়ে দেরি কমে এবং সরকার দ্রুত এই অর্থ খরচে সক্ষম হয়। এনবিআর কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে গত ১ ও ২ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এরপর ৩ জুলাই সোনালী ব্যাংকসহ দেশের সব তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে কাস্টমস শুল্ককর সফলভাবে আদায় শুরু হয়। ওইদিনই ৭৫টি বিল এন্ট্রির বিপরীতে ১৩ কোটি টাকারও বেশি শুল্ক সরাসরি কোষাগারে জমা হয়েছে।
এনবিআর জানায়, করদাতারা ঘরে বসে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (রকেট, বিকাশ, নগদ, উপায়, এমক্যাশ, ট্রাস্ট-পে ইত্যাদি) ব্যবহার করে অনলাইনে শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে পণ্য খালাসের রিসিপ্ট নম্বর পাবে। এছাড়া দেশের ৬১টি ব্যাংকের ১১ হাজার ৭০০ শাখায় গিয়ে ক্যাশ বা চেকের মাধ্যমে শুল্ক পরিশোধ করেও দ্রুত পণ্য খালাস সম্ভব হবে।
বিদ্যমান আরটিজিএস পদ্ধতিতে করদাতারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুল্ক জমা দেন। কিন্তু সরকারি ট্রেজারিতে তা পৌঁছাতে কয়েকদিন সময় লাগে, ফলে সরকারের আর্থিক প্রবাহে সমস্যা দেখা দেয়। নতুন ‘এ-চালান’ পদ্ধতিতে যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে দ্রুত অনলাইনে শুল্ক পরিশোধ সম্ভব, যা সরকারের নগদ প্রবাহ ত্বরান্বিত করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “সরকারি রাজস্ব আদায়ে এই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি সময়োপযোগী ও অত্যন্ত কার্যকর। এতে দণ্ডনীয় দুর্নীতি ও অর্থের অব্যবস্থাপনা কমে আসবে। সরকার দ্রুত আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।”
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশ্লেষক ড. সুমন চক্রবর্তী বলেন, “ই-চালানের মাধ্যমে শুল্ক আদায় প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশকে উন্নত করবে। দীর্ঘদিন ধরে কাস্টমসের জমা প্রক্রিয়ায় সময়ের অপচয় ও ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
টেকনোলজি বিশ্লেষক ফারহান মাহমুদ বলেন, “জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ‘এ-চালান’ সিস্টেমের ইন্টিগ্রেশন অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এটি শুধু শুল্ক আদায় প্রক্রিয়া নয়, বরং ডিজিটাল বাংলাদেশের দিকেও বড় একটি পদক্ষেপ। সরকারি অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এই ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন।”
বাণিজ্য ও আমদানিকারক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাও ‘এ-চালান’ পদ্ধতির স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “ঘরে বসে শুল্ক পরিশোধের সুবিধা পেলে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের সময় ও খরচ অনেক কমে যাবে। এ কারণে পণ্য দ্রুত খালাস ও বাজারজাতকরণ সম্ভব হবে, যা ব্যবসার গতিশীলতা বাড়াবে।”
যদিও নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনে বেশ কিছু প্রযুক্তিগত ও প্রশিক্ষণগত চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকার ইন্টারনেট সংযোগ ও ডিজিটাল সाक्षরতার ক্ষেত্রে। এনবিআর ইতোমধ্যে দেশের সকল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে নজর দিয়েছে এবং করদাতাদের জন্য তথ্য ও সহায়তা প্রদান বাড়িয়েছে।
এনবিআরের সিনিয়র কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা নিশ্চিত করছি যে নতুন পদ্ধতিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকারীরা সুবিধা পাবে। সরকারি রাজস্ব আদায় আরও দ্রুততর ও সুশৃঙ্খল হবে। সরকারি তহবিলের অটোমেশন ও নির্ভুল হিসাবরক্ষণে ‘এ-চালান’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
সমগ্র প্রক্রিয়াটির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের শুল্ক আদায় ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। এর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ হবে অধিকতর স্বচ্ছ, দ্রুত এবং নির্ভুল। করদাতাদের জন্য ঝামেলা কমে, ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন সহজ হওয়ায় দেশের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পাবে।
৭ জুলাই থেকে দেশে সব কাস্টম হাউসে ‘এ-চালান’ পদ্ধতির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বাণিজ্য ও সরকারি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এটি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ